ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : খুলনায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার সাপের বিষসহ ৩ জনকে আটক করেছে র্যাব-৬। বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) সকালে মহানগরীর জিরোপয়েন্ট এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। আটককৃতরা হলেন, পাবনার নুরুল সরদারের ছেলে বাচ্চু সরদার, ইব্রাহিম পরামাণিকের ছেলে লুৎফর রহমান ও যশোরে রামচন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে সৌমিত্র বিশ্বাস।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন র্যাব-৬ খুলনার উপ-অধিনায়ক মেজর আনিস। তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাবের একটি আভিযানিক টিম বৃহস্পতিবার সকাল ৬ টায় নগরীর জিরোপয়েন্ট এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাপের সাপের বিষসহ তিনজনকে আটক করে। র্যাব-৬ শতকোটি টাকার সাপের বিষ বহনকারীদের আটক করলেও বিষপাচার চক্রের মূল হোতারা রয়েছেন ধরা ছোয়ার বাইরে ।
র্যাব-৬ এর হাতে আটককৃতদের কাছ থেকে ৬ টা সীল করার বোতলে ১৬ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক মূল্য ১০০ কোটি টাকা হবে। আটকৃতদের র্যাব-৬’র সদর দপ্তরে আনা হয়েছে। তারা যশোর ও পাবনা এলাকায় বসবাস করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বেশকিছু তথ্য দিয়েছে। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে জানাযায়,সাপের বিষ পাচারে নিরাপদ রুট বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাখুলনা, সাতক্ষীরা-যশোর অঞ্চলেও রয়েছে এই চক্রটির শক্তঘাটি ! খুলনার বয়রা এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যাক্তি সাপের বিষ পাচারের সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন । সাপের বিষসহ বিভিন্ন সময় বহনকারীরা আটক হলেও বিষ পাচার চক্রের মূল হোতা ঐ প্রভাবশালী ব্যাক্তি থেকে যাচ্ছেন ধরা ছোয়ার বাইরে । নগরীর বয়রা এলাকার ঐ প্রভাবশালীকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেই দেশ বিদেশে বিষ পাচার চক্রের সিন্ডিকেটকে চিহৃত করা সম্ভব হবে ।
উল্লেখ্য সাপের বিষ পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশ। আর এর সাথে খুলনা মহানগীর ,সাতক্ষীরা, বেনাপোল, যশোর, কুমিল্লা ও ফেনীসহ কয়েকটি এলাকার একাধিক চক্র জড়িত। এ সিন্ডিকেট সদস্যরা বছরে অন্তত একশ’ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষ পাচার করে থাকে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে অনুসন্ধানে ।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার দক্ষিণখান এলাকা থেকে কাঁচের জারে রক্ষিত অবস্থায় প্রায় নয় কেজি ওজনের সাপের বিষসহ ৬ জনকে র্যাব আটক করেছে। পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব জানিয়েছে, ঢাকা থেকে উদ্ধার করা এসব সাপের বিষের আনুমানিক মূল্য ৭৫ কোটি টাকা এবং তাদের ধারণা বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে এগুলো পাচারের জন্য আনা হয়ে থাকতে পারে।
আটককৃতদের সাথে কাঁচের জারে রক্ষিত অবস্থায় ৮ দশমিক ৯৬ কেজি সাপের বিষ পাওয়া যায়। এছাড়া তাদের কাছ থেকে সাপের বিষ সংক্রান্ত সিডি ও সাপের বিষ নিয়ে ম্যানুয়াল বই উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, বেশি মুনাফার লোভে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাপের বিষ সংগ্রহ করে চোরাচালান করে আসছিল তারা,র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
র্যাবের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলছেন তারা যখন সাপের বিষের জার উদ্ধার করেছেন তার ওপরে লেখা ছিল ‘মেড ইন ফ্রান্স’। ‘গ্রেফতারকৃত আসামীরা একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক সাপের বিষ চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্য। এছাড়াও আটককৃত আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে,’ বলছে র্যাব। এর আগে গত ২৫ নভেম্বর গাজীপুর থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ কয়েকজনকে আটক করেছিলো পুলিশের আরেকটি সংস্থা সিআইডি। তারও আগে চলতি বছরেই জুন মাসে ফেনীতে দুই পাউন্ড সাপের বিষসহ এক ব্যক্তিকে আটক করেছিলো র্যাব।
এর আগেও কয়েক বছর ধরে সাপের বিষ উদ্ধারের খবর নিয়মিতই পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ঢাকা থেকেই ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করেছিল পুলিশ, তখন যার মূল্য ছিল প্রায় ৬৮ কোটি টাকা। তার আগের বছর চুয়াডাঙ্গা থেকে ১২ কোটি টাকা মূল্যের বিষ উদ্ধার করা হয়েছিল।
অন্যদিকে ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে জলপাইগুড়িতে প্রায ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষ উদ্ধারের ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো। তখন সেখানকার কর্মকর্তারা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন এগুলো বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়েছে। কিন্তু এ বিষ আসে কোথা থেকে ? গাজীপুরে বিষ উদ্ধারের পর সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার বলেছিলেন তারা যে বিষ উদ্ধার করেছিলেন তার জারগুলোতেও মেড ইন ফ্রান্স লেখা ছিল। তিনি অবশ্য বলেছিলেন যে বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিষ পাচার হয়। আবার কখনো সেসব দেশ থেকে এনেও অন্য দেশে নেয়া হয়।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশের আইনে সাপের বিষের লেনদেন বা ক্রয় বিক্রয় এবং পাচার দন্ডনীয় অপরাধ। তারপরেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধারণা বছরে অন্তত একশ কোটি টাকা মূল্যের বিষ পাচার হয় বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে। ফেনী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, যশোর,খুলনা, কুমিল্লাসহ কয়েকটি এলাকায় একাধিক চক্র গড়ে ওঠেছে । আর এই চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতাবশালী ব্যাক্তিরা । যারা সাপের বিষ সংগ্রহ ও চোরাচালানের সাথে জড়িত বলে পুলিশের ধারণা।
যদিও বিষ কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায় এ প্রশ্ন তোলার আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে যা উদ্ধার করা হয়েছে তা আসলে সাপের বিষ কি-না। এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির অধ্যাপক মো. আবু রেজা। তিনি সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করেন।
এই গবেষক জানান, কয়েক বছর আগে এমন উদ্ধার করা সাপের বিষের নমুনা পরীক্ষার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেগুলো বিষ ছিল না। তবে সেগুলো কি তা আমিও নিশ্চিত নই। মনে হয়েছিল মাদক জাতীয় কিছু হতে পারে। স্বল্প মাত্রায় সাপের বিষ দিয়ে মাদকের প্রচলন কোথাও কোথাও রয়েছে। তবে যা উদ্ধার হয়েছে তা নিয়ে যথাযথ পরীক্ষা হওয়া দরকার বলে মনে করেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।