মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: দেশের ডেইরি উন্নয়ন যেকোনোভাবেই হোক আমরা করবো। ডেইরি সেক্টরের টোটাল সলিউশন আমাদের রয়েছে। গরুর সিমেন (বীজ) থেকে শুরু করে ফিড, ওষুধ, ভ্যাকসিন, চিকিৎসা, পরামর্শ সেবা এবং যেটিকে ফরোয়ার্ড লিংকেজ বলে অর্থাৎ ভোক্তা পর্যায়ে দুধ ও মাংস পৌঁছে দেয়া সবকিছুই আমাদের রয়েছে। আমাদের উৎপাদিত সিমেনের মাধ্যমে মাত্র দেড় বছরে আমরা প্রায় দুই লাখ উন্নত জাতের গরু তৈরি করতে পেরেছি। এখন প্রতি মাসে গড়ে ৫০ হাজার সিমেন বিক্রি হচ্ছে। খুব শীঘ্রই আমরা ফার্টাল অ্যামব্রায়োতে (Fertile Embryo) বা গাভীতে উর্বর ভ্রূণ প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নত জাতের গরু তৈরি করা। আমরা চাই, দেশ শুধু দুধ ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণই থাকবে না, বরং দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে আমাদের ডেইরিজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করবে। এটা নিছক স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই করা সম্ভব এবং আমরা সেটি করবো।
কথাগুলো বলছিলেন দেশের কৃষি, মৎস্য ও লাইভস্টক সেক্টরের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং অত্যন্ত পরিচিত মুখ এসিআই এগ্রিবিজনেস -এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ড. এফএইচ আনসারী।
ড. এফএইচ আনসারী বলেন, এসিআই ভারতের পুনেতে গোদরেজের সাথে যৌথভাবে একটি পরীক্ষামূলক খামার করেছে, যেখানে আমাদের দেশীয় জাতের গরুতে শতভাগ খাঁটি ফার্টাল অ্যামব্রায়ো প্রবেশ করানো হয়েছে। মূল উদ্দেশ্য দেশীয় গরুর জাতের উন্নয়ন। সেখানে ৫শ’টি গাভী রয়েছে যার প্রতিটি গড়ে সাড়ে ৩৯ লিটার দুধ দেয়। শুধু তাই নয়, আমরা সেখানে আমাদের ৪জন ভেটেনারিয়ান পাঠাবো যারা সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এসে আমাদের দেশের গাভীতে ফার্টাল এমব্রায়ো প্রয়োগ করবে এবং আস্তে আস্তে এটি আমরা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেবো। ডেইরি ডেভেলপমেন্টের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা, এবং দুই. উন্নত জাত দুটো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটোর সমন্বয় ঘটাতে পারলে সেক্টরটিতে সাফল্য আসবেই।
অনেকের ধারনা, বিশ্বের উন্নত গরুর জাত যেগুলো অধিক মাংস ও দুধ উৎপাদনকারী সেগুলো আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগি নয়। তারা মনে করেন, শীত প্রধান দেশের গরু কেবল শুধু শীত প্রধান দেশের জন্য এবং গরমপ্রধান দেশের গরু শুধু গরম আবহাওয়ার দেশের জন্য প্রযোজন্য। কিন্তু ধারনাটি ভুল। কারণ, গরু এমন একটি প্রাণী যাকে সঠিক ব্যবস্থাপনা, হাইজিন, খাবার ও পুষ্টি উপাদান দিলে সে বিশ্বের যে কোন স্থানের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। এখন তাকে যদি আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা, খাবার, পুস্টি, হাইজিন দিতে না পারি, সেটিতো গরু কিংবা আবহাওয়ার দোষ না। এক কথায়, যে কোন দেশের গরুই অন্য যে কোন দেশেই পালন এবং সেটিকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করা সম্ভব- যোগ করেন ড. আনসারী।
তিনি আরো বলেন, মাত্র দেড় বছর হলো এসিআই সিমেন ব্যবসা শুরু করেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে এসিআই সারাদেশে প্রায় ২ লাখ উন্নত জাতের গরু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। খামারি পর্যায়ে আমাদের উৎপাদিত সিমেন এতটাই আস্থার জায়গা করে নিয়েছে যে, দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সিমেন বিক্রিতে আমরা এখন দ্বিতীয় অবস্থানে আছি। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, গেল ডিসেম্বর মাসে আমরা ৭০ হাজার সিমেন বিক্রি করেছি। গাজীপুরে অবস্থিত আমাদের বুল স্টেশনে ৬০টিরও বেশি ষাঁড় পালন করা হচ্ছে, যাদের কাছ থেকে অত্যন্ত আধুনিক পদ্ধতিতে বিশ্বমানের সিমেন সংগ্রহ এবং বাজারজাত করা হচ্ছে।
ড. আনসারী এ প্রতিবেদককে জানান, আগামী এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আমরা গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভ্যাকসিন নিয়ে আসবো। ১ বছরের মধ্যে আমাদের দেশীয় গরুতে ফার্টাল অ্যামব্রায়ো ট্রান্সফার করবো। ঢাকার গুলশানে আমাদের অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরী রয়েছে যেখানে কাজ করছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক, ডা. এম এ ছালেক এবং ডা. অরবিন্দ কুমার সাহার মতো দেশের বিখ্যাত ভেটেনারিয়ান ও বিশেষজ্ঞগণ। গাজীপুরে রয়েছে আমাদের অত্যাধুনিক বুল স্টেশন যেখানে আপাতত ফ্রিজিয়ান, শাহীওয়াল ও রেড চিটাগং জাতের গরুর সিমেন উৎপাদন করা হচ্ছে।
‘ক্যাটল ফিডে (এসিআই গোদরেজ) দেশে আমরা নাম্বার ওয়ান। আমাদের নিউট্রিশনাল পণ্য থেকে শুরু করে ওষুধ, হাইজিন পণ্য যেমন- মশা ও মাছি তাড়ানোর নেট, অ্যাপসের মাধ্যমে খামারিদের বিভিন্ন সমস্যার বিনামূল্যে পরামর্শ সেবা এবং স্বপ্ন আউটলেটের মাধ্যমে দুধ ও মাংস বিক্রির মাধ্যমে ফরোয়ার্ড লিংকেজ পর্যন্ত পৌঁছেছে এসিআই। অর্থাৎ ডেইরি-ক্যাটলের টপ টু বটম সবকিছু রয়েছে আমাদের। মোদ্দা কথা, যেকোভাবেই হোক আমরা দেশের ডেইরি ডেভেলপমেন্ট করবোই’ বলেন, ড. আনসারী।,
ড. আনসারি জানান, আমাদের খামারি অ্যাপসের মাধ্যমে আমরা দেশের ১২শ’ ভেটেনারিয়ানকে যুক্ত করেছি যার মাধ্যমে খামারিরা বিনামূলে যে কোন সমস্যার তাৎক্ষণিক সেবা পেয়ে থাকেন। ইতিমধ্যে আমরা দেশে ৪ হাজার খামার এবং ৬ হাজার ৭শ’ ওষুধের খুচরা দোকানদারকে উক্ত অ্যাপস এ যুক্ত করেছি। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখান থেকে বিশেষজ্ঞ, খামারি এবং দোকানদার তিনটি প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন।
আমাদের দেশে গরুর মাংসের দাম পার্শ্ববর্তী এমনকি পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের চাইতেও বেশি ভোক্তাদের এমন অফিযোগ যেমন আছে, তেমনি আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি খামারিদের পক্ষ থেকে এমন দাবীও আছে, এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি? জানতে চাইলে ড. আনসারি বলেন, উভয়ের বক্তব্যই সঠিক। এর মূল কারণ উন্নত ব্রিড বা জাতের অভাব এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা । আমাদের দেশে তেমন উন্নত জাতের ব্রিড নেই বলে এক কেজি মাংস উৎপাদন করতে যেখানে প্রায় ১২ কেজি খাবারের প্রয়োজন হয়, সেখানে উন্নত জাতের গরুর জন্য প্রয়োজন হয় মাত্র ৪-৫ কেজি। অর্থাৎ আমাদের খাদ্য খরচ দ্বিগুনেরও বেশি কিন্তু আউটপুট অর্ধেকেরও কম। খুব স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন খরচ বেশি হয়। এক্ষেত্রে আমাদের এফসিআর উন্নত করতে হবে, এটি সম্ভব তখনই যখন আমরা ভালো ব্রিড বা জাতের গরু পালন করবো। অন্যদিকে সঠিক ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনার অভাবেও বাড়তি খরচ হয়, এদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। উন্নত ব্রিড এবং ব্যবস্থাপনা- এ দুটো বিষয়কে যখন আমরা সমন্বয় করতে পারবো তখন উৎপাদন খরচ কমবে এবং খামারি ও ভোক্তা উভয়েরই স্বস্তি মিলবে। আমরা উক্ত বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দিচ্ছি।
পৃথিবীতে যতগুলো আধুনিক এবং টেকসই ব্রিড আছে এসিআই সেগুলো নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। এমনকি মাংস উৎপাদনে বিশ্বের সবচেয়ে অধিক উৎপাদনশীল বেলজিয়া ব্লু জাতের গরু নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের এবং সেটিকে এদেশে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করবো। আমাদের লক্ষ্য দেশের ডেইরি সেক্টরকে উন্নত বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং বিশ্বায়নের যুগে তাল মিলিয়ে চলা। আমরা আশাবাদী, দেশের চাহিদা মিটিয়ে এদেশের মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য একদিন আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজারে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করবে।