বৃহস্পতিবার , ডিসেম্বর ২৬ ২০২৪

এসিআই বুল স্টেশন : গরুর জাত উন্নয়ন বিপ্লবে দেশের গর্বিত অংশীদার

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: সারাবিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান প্রাণিসম্পদের মধ্যে অন্যতম গবাদিপশু। উন্নয়নশীল বিশ্বে মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহে গরু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশে গবাদিপশুর সংখ্যা আড়াই কোটি। তবে দেশে সংখ্যাগত দিক দিয়ে গরুর সংখ্যা বেশি হলেও অর্থনীতিতে সেইভাবে অবদান রাখছে না। বিশাল পরিমাণে গবাদিপশুর বিপরীতে প্রয়োজনীয় দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদির মধ্যে শতকরা ৫৬ ভাগের বেশি আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে দৈনিক দুধ গ্রহণের হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কিন্তু আশার খবর হচ্ছে, ইদানিং দেশের প্রচুর শিক্ষিত যুবক এবং বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তারা খাতটিতে আত্মনিয়োগ করছেন। সমস্যা হচ্ছে উন্নত জাত এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বাণিজ্যিকভাবে সবাই সফল হতে পারছে না। তাই সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গরুর জাত উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগী হচ্ছে।

গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শামিল হতে উদ্যোগ নিয়েছে দেশের কৃষি সেক্টরের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি এসিআই লিমিটেড। “বদলে যাবে সারাদেশ, দুধে-মাংসে বাংলাদেশ” এই শ্লোগান নিয়ে কোম্পানিটি গাজীপুরে গড়ে তুলেছে বিশ্বমানের অত্যাধুনিক ‘এসিআই এ্যানিম্যাল জেনেটিক’ বুল স্টেশন। উদ্দেশ্য উন্নত মানের সিমেন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন বিপ্লবে গর্বিত অংশীদার করা। আসুন তাহলে জেনে নিই ‘এসিআই অ্যানিম্যাল জেনেটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ সম্পর্কে:

বায়োসিকিউরিটি সমৃদ্ধ ‘এসিআই অ্যানিম্যাল জেনেটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে প্রবেশ পথ।

গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরের রাজাবাড়ীতে অবস্থিত ‘ এসিআই অ্যানিম্যাল জেনেটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নামক বুল স্টেশনে ঢুকতে গেলেই আপনাকে প্রথমেই যে বিষয়টি নজরে আসবে সেটি হলো- এখানকার কঠোর জীব নিরাপত্তা (Bio Security) ব্যবস্থা। যেহেতু সেখানে লাইভ এনিমেল আছে এবং মানুষের মাধ্যমে রোগবালাই আসতে পারে, তাই এমন কঠোর ব্যবস্থা।

পুরো বুল স্টেশনকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে বুল সংরক্ষণের জন্য ‘বুল শেড’ এবং দ্বিতীয়টি হলো সিমেন প্রসেসিং ল্যাবরেটরী। বুল শেডে রয়েছে বিভিন্ন উন্নত জাতের ৫০টি ষাঁড়। সেগুলো থেকে স্পার্ম সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরীতে প্রসেসিং করে সরবরাহ উপযোগী সিমেন তৈরি করা হয়। আপাতত ফ্রিজিয়ান, শাহীওয়াল ও রেড চিটাগং এই তিন জাতের গরুর সিমেন সেখানে উৎপাদন করা হয়।

ষাঁড় থেকে সিমেন সংগ্রহ করা হচ্ছে।

বুল শেডে রাখা উন্নত জাতের গাভীগুলোকে পরিচর্যা করার জন্য অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়; গরুর খাদ্য, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, আবহাওয়া সম্পৃক্ত বিষয়, তাপমাত্রা, আর্দ্রতার মতো সবগুলো বিষয় অতি সূক্ষভাবে খেয়াল রাখা হয়।

শুধু তাই নয়, একটি আদর্শ ষাঁড়কে নিয়মিত ব্যায়াম করাতে হয়। সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে বুলশেডে। প্রতিটি ষাঁড়ের জন্য ৭শ’ বর্গ ফুট জায়গা বরাদ্দ রয়েচে, যাতে সেখানে তারা স্বাচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে। এছাড়াও ভালো সিমেন উৎপাদনের জন্য কাঁচাঘাস অপরিহার্য, সেজন্য স্টেশন প্রাঙ্গনেই রয়েছে জমি এবং চাষ করা হচ্ছে ঘাস।

এসিআই বুল স্টেশনে কর্মরত বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাগণ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতের গরুর কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন ব্লাড লেভেলের গরু রাখা হয়েছে স্টেশনে। এর মধ্যে কোনটা সংকর জাতের, কোনটা একেবারে বিশুদ্ধ জাতের। এ রকম রাখার কারণ হলো- খামারি যে গরুর উপর সিমেন ব্যবহার করবেন তার জাত কোনটি সেটি নিশ্চিত হওয়া। যেমন- কারো যদি ফ্রিজিয়ান জাতের গাভী থাকে তাহলে তিনি ফ্রিজিয়ান জাতের ষাড়ের সিমেন নিতে হবে, আবার যদি শাহীওয়াল ক্রস জাতের হয়, তাহলে তাকে শাহীওয়াল ক্রস সিমেন নিতে হবে। অন্যদিকে দেশি জাতের গাভী হলে শাহীওয়াল অথবা ফ্রিজিয়ান যে কোন একটি জাতের সিমেন ব্যবহার করতে পারেন।

সিমেন তৈরির প্রক্রিয়া

প্রথমে ষাঁড় থেকে স্পার্ম সংগ্রহ করার পর, খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা হয় তাতে কোন ফিজিক্যাল এ্যাবনরমালিটি আছে কি না (যেমন- রক্ত, পুঁজ, চুল)। তারপর এটিকে (সিমেন) খুব দ্রুত ওয়াটার বাথে মোটামুটি ষাঁড়ের দৈহিক তাপমাত্রার কাছাকাছি রাখা হয়। সিমেনগুলোকে দৈহিক তাপমাত্রায় রাখার পর শুক্রানূর ঘনত্ব পরীক্ষার জন্য এবার সেগুলোকে সোডিয়াম ক্লোরাইডে মিশিয়ে কিছুক্ষণ রাখা হয়। তারপর সিমেনের সমপরিমান মিডিয়া মেশানো হয়, যাতে শুক্রানূগুলো সতেজ থাকে, পুষ্টিপ্রাপ্ত হয় এবং ঠাণ্ডা ও গরম থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।

এরপর সিমেনগুলোকে ল্যাবরেটরীতে থাকা জার্মান প্রযুক্তিতে তৈরি কম্পিউটার এসিস্ট্যাড সিমেন এ্যনালাইজারস এর নিয়ে যাওয়া হয়, যার মাধ্যমে সিমেনের গুণগত মান নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যায়। সেখানে সবগুলো মানদণ্ড সম্পন্ন হলে, পরবর্তীতে অন্য আরেকটি মেশিনে নিয়ে যাওয়া হয় সিমেনের ঘনত্ব পরীক্ষার জন্য। সব ঠিক থাকলে সিমেনগুলো এবার আরেকটি মেশিনে চলে যায় এবং সেখানে পরিমান অনুযায়ী মিডিয়া মেশানো হয়। এরপর সিমেনগুলো একটি কম্বি সিস্টেম প্যাকেজিং মেশিনে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে সেগুলোকে সিলিং, ফিলিং এবং প্রিন্টিং করা হয়। মেশিনটি প্রতি ঘণ্টায় ১৫ হাজার ডোজ সিমেন মোড়কজাত করতে পারে।

এভাবেই প্যাকেটজাত করে সরবরাহ করা হয় এসিআই সিমেন।

সিমেন এর প্রতিটি ডোজকে যেভাবে মোড়কজাত করা হয়, সেটি দেখতে অনেকটা কোমল পানীয় পান করার স্ট্র’র মতো। সেটির গায়ে গায়ে ষাঁড়ের নাম, আইডি এবং উৎপাদন তারিখ লেখা থাকে। মোড়কজাত হওয়ার পর সেগুলোকে আবার কুলিং মেশিনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে শীতলীকরণ করা হয়। পরবর্তীতে এগুলোকে তরল নাইট্রোজেনে সংরক্ষণ করা হয়। সর্বশেষ বাজারজাত করার আগে প্রতিটা সিমেন ডোজকে পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা হয়, এতসব ধকল কাটানোর পর সিমেন জীবীত আছে কি না। পরীক্ষা করার পর চূড়ান্তভাবে সংরক্ষণ করা হয় এবং সেটিকে খামারি পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হয়।

সিমেনের কোয়ালিটি

এ সম্পর্কে এসিআই এগ্রিবিজনেস –এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ড. এফএইচ আনসারী বলেন, ড. আনসারী বলেন, সিমেন উৎপাদন থেকে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি পর্বে খুবই যত্নশীল হতে হয় এবং আমরা সেটি করি। একটি গাভীকে বীজ (সিমেন) দেয়ার পর গর্ভধারন করলো কি না সেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, খামারি যখন দেখবেন দেখে এটার গর্ভধারন ক্ষমতা ভালো তাহলেই তিনি সেটি ব্যবহার করবেন। আরেকটি বিষয় হলো- সিমেন থেকে তৈরিকৃত গাভী কিংবা ষাঁড় সেগুলোর দুধ ও মাংস উৎপাদন কেমন হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনা নিলে, এসিআই অবশ্যই সেরা।

অত্যাধুনিক ল্যাবে সিমেনের গুণগত মান পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

ড. আনসারী বলেন, দেশকে দুধে মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ডেইরিকে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান করতে চাইলে উন্নত জাতের গরুর বিকল্প নেই। শুধুমাত্র সঠিক জাত এবং ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের অনেক উদ্যোক্তা খাতটিতে বিনিয়োগ করে হোচট খাচ্ছেন। উন্নত জাতের একটি গরুর পেছনে যতটুকু খরচ করে দুধ ও মাংস উৎপাদন হয়, সেই পরিমাণ খরচ করে আমাদের প্রচলিত জাতের গরুতে অর্ধেকও আউটপুট আসে না। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, খামারি ও ভোক্তা উভয়েই ঠকছেন। এজন্য আমরা কৃত্রিম প্রজনন ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছি এবং মাত্র দেড় বছরে আমরা ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি।

এসিআই সিমেন থেকে উৎপাদিত বাঁছুর।

শুধু তাই নয়, শীঘ্রই আমরা ফার্টাল এম্ব্রায়ার ট্রান্সফারের মাধ্যমে গাভীর উৎপাদনশীলতা বাড়াবো। ফার্টাল এম্ব্রায়ার এর মাধ্যমে ২৩ মাসে যদি একটি গাভী তৈরি করা যায়, তাহলে একটি গাভী থেকে ৪০ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া সম্ভব এবং সেটি লাভজনক, যোগ করেনে ড. আনসারী।

ড. আনসারী জানান, কৃত্রিম প্রজনন (এআই) প্রযুক্তির মাধ্যমে এই ব্যবসাটি সারা দেশে দুধ এবং মাংস উত্পাদনসহ উচ্চ উৎপাদনশীল গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। পরিচালনার মাত্র এক বছরের মধ্যে, এসিআই অ্যানিম্যাল জেনেটিক ব্যবসায় ইতিমধ্যে দেশের সিমেন বাণিজ্যের বাজারের ৭% শেয়ার অর্জন করেছে।

সংশ্লিষ্টখাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃত্রিম প্রজনন (এআই) একটি অন্যতম সেরা প্রযুক্তি যা বাংলাদেশের খামারিদের ভাগ্য উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করতে পারে, কারণ সঠিক এআই প্রয়োগের মাধ্যমে একটি গাভী উচ্চতর গুন/বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে। বর্তমানে স্থানীয় গাভীর উত্পাদিত দুধের হার গড়ে প্রতিদিন ২ লিটার। এআই প্রযুক্তির কারণে এই পরিমাণটি প্রতিদিন ৪৫ লিটার পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া এআইয়ের কারণে গবাদিপশুর অধিক উত্পাদনশীলতা কৃষকদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করবে।

This post has already been read 14512 times!

Check Also

বিএলআরআইতে ‘বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালা-২০২৪’ অনুষ্ঠানের সমাপনী অনুষ্ঠিত

নিজস্ব সংবাদদাতা: বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) কর্তৃক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সমাপ্ত গবেষণাসমূহের ফলাফল ও অগ্রগতি …