খুলনা সংবাদদাতা: মৎস্য চাষ ও উৎপাদনে বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সাফল্য সারা বিশ্বের কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু মৎস্য ও চিংড়ি রোগের মারাত্মক প্রাদুর্ভাবের কারণে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিন দিন চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। যে কারণে চিংড়ি থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বর্তমানে নিম্নমুখী। এমতাবস্থায়, মাছ ও চিংড়ির পুকুরের সমস্যা নিয়ে নিঁখুত গবেষণা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে এই শিল্পের সাথে জড়িত সকল হ্যাচারি, নার্সারি ও মজুদ চাষের পুকুরের কথা বিবেচনায় রেখে দেশের মৎস্য সেক্টরের স্বনামধন্য কোম্পানি ফিসটেক (বিডি) লিমিটেড খুলনায় বাংলাদেশের প্রথম আরটি-পিসিআর (রিয়াল-টাইমপলিমারেজ চেইনরিয়েকশান) ভিত্তিক মলিকু্লার ল্যাবরেটরী স্থাপন করেছে, যেখানে নূন্যতম মূল্যের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সেবা নিতে পারবেন সংশ্লিষ্ট সকলেই।
বৃহষ্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) এ উপলক্ষ্যে একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ফিসটেক (বিডি) লিমিটেড -এর চেয়ারম্যান খন্দকার ফরহাদ হোসেন -এর সভাপতিত্বে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মোসাৎ হোসনা আরা ফিতা কেটে ল্যাবরেটরী উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ফিসটেক (বিডি) লিমিটেড -এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউল করিম ভূঁইয়া, পরিচালক মোহাম্মদ তারেক সরকার (গবেষণা এবং উন্নয়ন) এবং প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠঅনে মৎস্য ও চিংড়ির আধা-নিবিড় চাষ ব্যবস্থাপনায় রোগ নির্ণয়ের জন্য আধুনিক পরীক্ষাগারের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. মীর মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন। মৎস্য অধিদফতর ও খুলনা বিভাগের কর্মকর্তা ও ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবু সাইদ, আবদুর রাজ্জাক, উপপরিচালক (মাছ পরিদর্শন ও গুণ নিয়ন্ত্রণ) এবং এবিএম জাকারিয়া, কোয়ারেন্টাইন অফিসার, (মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, ‘ফিসটেক ল্যাবরেটরি’ নামক ল্যাবরেটরিটি ইউএসএআইডি সহ অর্থায়নে ফিড দ্যা ফিউচার বাংলাদেশ অ্যাকোয়াকালচার অ্যাক্টিভিটি প্রকল্পের আওতায় যৌথভাবে বাস্তবায়ন করে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশ এবং ফিসটেক (বিডি) লিমিটেড। উক্ত আরটি-পিসিআর -এর মাধ্যমে মাছ ও চিংড়ির ১১ ধরণের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি, মাটি ও পানির ১৮টি গুণাবলির পরীক্ষার-নিরীক্ষার জন্য ল্যবরেটরিটিতে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অত্যন্ত মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মৎস্য ও চিংড়ির নানাবিধ রোগ নির্ণয়, সংশ্লিষ্ট খামারের মাটি-পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি পুকুরের সঠিক সমস্যা নিণর্য়ের মাধ্যমে মৎস্য ও চিংড়ি চাষিদের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ও লাভ নিশ্চিত করা সহজ হবে।
প্রকল্পটিতে পরামর্শক হিসেবে রয়েছেন, থাইল্যান্ডের মাহিদোল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইক্সিলেন্স অব শ্রিম্প -এর প্রধান গবেষক ড. শেংচান সেনাপিন। প্রকল্পের সমন্বয়ক রয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ এন্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ও মৎস্য ও চিংড়ি রোগ বিদ্যার স্বনামধন্য গবেষক ড. মির মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন। পরীক্ষাগারটিতে নিবিড়ভাবে রোগ নির্ণয়ের জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকত্তর সম্পন্ন দুইজন টেকনিশিয়ান নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়েছে। ফিসটেক ল্যাবরেটরি এর প্রফিসিয়েন্সি টেস্ট ও যৌথ গবেষণা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক রয়েছে আরো দুইটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্স ল্যাবরেটরির সাথে। উক্ত ল্যাবরেটরি বাংলাদেশের মৎস্য ও চিংড়ি শিল্পের ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগে একটি যুগান্তকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন উপস্থিত মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও চাষিগণ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ অ্যাকুয়াকালচার অ্যাক্টিভিটি, ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ -এর পর্যবেক্ষণ মূল্যায়ন ও শিক্ষণ বিশেষজ্ঞ ফাতিমা শাহীন কাশফী বলেন, “USAID এর অর্থায়নে WorldFish এর বাস্তবায়নে Feed the Future Bangladesh Aquaculture Activity প্রকল্পের আওতায় ফিসটেক কর্তৃক বাস্তবায়িত দেশের প্রথম বেসরকারি খাতের এই পরিক্ষাগারটি আণবিক পর্যায়ে মৎস্য রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মাটি ও পানির গুনাগুণ পরীক্ষা করতে সক্ষম। আজ এই পরিক্ষাগারের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমি এর উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি।“
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সামুদ্রিক সম্পদ প্রযুক্তি বিভাগের ডীন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আবদুর রউফ ছাড়াও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সরোয়ার উপস্থিত ছিলেন এবং পরীক্ষাগারের সম্ভাবনা সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন।
ফিসটেক (বিডি) লিমিটেড -এর পরিচালক মোহাম্মদ তারেক সরকার (গবেষণা এবং উন্নয়ন) বলেন, আমাদের শুধু মাছ চাষ এবং উৎপাদন বাড়ালেই চলবে না। দেশের মৎস্য শিল্পকে টেকসই করতে হলে রপ্তানির দিকে জোর দিতে হবে। আর রপ্তানির জন্য গুড অ্যাকোয়াকালচার প্র্যাকটিসের বিকল্প নেই। গুড অ্যাকোয়াকালচার প্র্যাকটিসের অন্যতম প্রধান বাঁধা মাছের রোগ-বালাই। ‘ফিসটেক ল্যাবরেটরি’ আন্তর্জাতিম মানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে স্থাপিত হওয়ার কারণে উল্লেখিত সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। শুধু তাই নয়, দেশের মৎস্য উন্নয়নে ল্যাবরেটরীটি একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
ল্যাবরেটরীটি খুলনায় স্থাপনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের দেশে মৎস্য রপ্তানি বলতে মোটা দাগে চিংড়িকেই বুঝায় এবং চিংড়ি চাষ সবচেয়ে বেশি এ অঞ্চলেই হয়। ফলে চিংড়ির রোগবালাই সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন এ অঞ্চলের চাষিদের হতে হয়। আমরা রপ্তানিমুখী চিংড়ি শিল্পকে আরো টেকসই এবং চাষিদের সহযোগিতার জন্য ল্যাবরেটরীটি স্থাপন করেছি। ল্যাবরেটরীটি স্থাপনে সহযোগিতার জন্য ওয়ার্ল্ডফিশকে ধন্যবাদ জানান এ সময় তারেক সরকার।
এছাড়াও পরীক্ষাগারটি উদ্বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চল তথা সমগ্র বাংলাদেশের মৎস্য চাষে ব্যাপক উন্নতি সাধন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল অতিথিবৃন্দ।