শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যুগোপযোগি সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদ

কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন : ফসল কাটার সময় শ্রমিক সংকট এখন বাংলাদেশে নিত্যবছরের সমস্যা। শিল্পায়নের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে কয়েক দশক ধরে মানুষ শহরমুখী। তাই প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি শ্রমিক। সামনে এ সংকট আরও বাড়বে বৈ কমবে না। এর একটা সমাধান হতে পারে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। কেননা আধুনিক কৃষি যন্ত্রগুলো অল্প সময়ে অনেক বেশি কাজ করে। আর এগুলো চালনার জন্য লোকও লাগে কম। কিন্তু যান্ত্রিকীকরণের জন্য দরকার বড় জমি, যৌথ খামার বা সমবায়ী কৃষিব্যবস্থা। উত্তরাধিকার বিভাজনসহ নানা কারণে আমাদের দেশের জমিগুলো ছোট ছোট। কৃষকেরা এগুলো জোড়া লাগানোর ব্যাপারেও খুব একটা উৎসাহী নয়। তাছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণের আরেকটি অন্তরায় হলো সকল কৃষক একই সময়ে চাষাবাদ করে না। নানা জাতের ও সময়ের বীজ নির্বাচন করায় সবার বীজতলাও একসময় গজায় না, ফলে চারা রোপণের সময়ও হয় ভিন্ন, ধানও তাই একসময়ে পাকে না।

কর্তন কাজের জন্য বিভিন্ন জমিতে আলাদা সময়ে কৃষি যন্ত্রগুলোর ব্যবহার তাই অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হয় না। এ ক্ষেত্রে কৃষিবিজ্ঞানীরা ভাবলেন, কোনো একটি এলাকার কোনো একটি কৃষিপণ্য চাষের পুরো প্রক্রিয়াকে যদি একই সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা যেত, তাহলে কিন্তু জমির আল বজায় রেখেও লাভজনকভাবে যন্ত্র ব্যবহার করা যেত। তাই এর একটা কার্যকরী উপায় বের করেছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। পদ্ধতিটির নাম দিয়েছেন তাঁরা Synchronize Cultivation বা সমলয় চাষাবাদ।

বর্তমান সরকার কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করতে টেকসই যান্ত্রিকীকরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার একটি হচ্ছে সমবায় ভিত্তিক চাষাবাদ সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতি। যেখানে একটি মাঠে বা মাঠের একটি অংশের সকল কৃষক সবাই মিলে একসঙ্গে একই জাতের ধান একই সময়ে যন্ত্রের মাধ্যমে রোপণ করবেন। এ পদ্ধতিতে বীজতলা থেকে চারা তোলা, চারা রোপন ও ধানকর্তন সব প্রক্রিয়া যন্ত্রের সাহায্যে সমসময়ে সম্পাদন করা হবে। সমলয়ে ধান আবাদ করতে হলে চারা তৈরি করতে হবে ট্রেতে। ট্রেতে চারা উৎপাদনে জমির অপচয় কম হয়। রাইস ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে চারা একই গভীরতায় সমানভাবে লাগানো যায়। কৃষক তার ফসল একত্রে মাঠ থেকে ঘরে তুলতে পারেন।

কারণ, একসঙ্গে রোপণ করায় সব ধান পাকবেও একই সময়ে। তখন ধান কাটার মেশিন দিয়ে একই সঙ্গে সব ধান কর্তন ও মাড়াই করা যাবে। এসব কারণে সমলয় পদ্ধতিতে যন্ত্রের ব্যবহার সহজতর ও বৃদ্ধি হবে। ফলে ধান চাষে সময়, শ্রম ও খরচ কম লাগবে। এক্ষেত্রে কৃষক লাভবান হবেন এবং কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ পদ্ধতির প্রবর্তন সহজ হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম সমলয়ে চাষাবাদ কার্যক্রম প্রদর্শনী আকারে দেশের ১২টি জেলার ১২টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করে। এটি ব্যাপক সফলতা লাভ করায় ২০২০-২১ অর্থবছরেও কার্যক্রমটি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। চলতি বোরো মওসুমে আরো বিস্তৃত পরিসরে ৬১টি জেলায় এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। এটি বাস্তবায়নের সরাসরি দায়িত্বে আছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আর বিভিন্নভাবে কারিগরি সহযোগীতা প্রদান করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে একদিকে ধানের নতুন নতুন জাত দ্রুত সম্প্রসারণ এবং ধান চাষে যন্ত্রের ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে এক প্লট থেকে অন্য প্লটে কৃষি যন্ত্র পরিবহণে সময়ের অপচয় রোধ করা যাবে। ছোট আকারের জমিতেও লাভজনকভাবে পূর্ণ দক্ষতায় কৃষি যন্ত্র চালানো যাবে। কৃষি যন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হবে।

সম্প্রতি প্রণীত সরকারের সমলয় নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশের প্রতি উপজেলায় সমলয় কৃষক গ্রুপের মাধ্যমে প্রতি জেলায় নূন্যতম একটি উপজেলায় ০১টি সমলয় চাষাবাদ প্রদর্শনী সম্পন্ন করতে হবে। প্রথম বছর/মওসুমে যে গ্রুপের মাধ্যমে উক্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে পরবর্তী বছর/মওসুমে অন্য গ্রুপের মাধ্যমে তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতি গ্রুপে কৃষক সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩৫ জন এবং জমির পরিমাণ ৫০-৬০ একর হতে হবে। প্রতি গ্রুপে কৃষাণীর সংখ্যা সর্বনিম্ন ৩০% হতে হবে। জাতের জীবনকালের সাথে সমতাবিধান করে এমনভাবে ফসল জাত নির্বাচন, ম্যাট পদ্ধতিতে ধানের চারা উৎপাদন এবং রোপণ করতে হবে যাতে রাস্তার পাশের ধান আগে কর্তন এবং ভিতরের ফসল পরে কর্তন করা যায়। এতে ফসল উৎপাদনে যন্ত্রের ব্যবহার সহজ হবে।

সমলয় নীতিমালা অনুযায়ী, কৃষক নির্বাচন, তাদের অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত ও অনুমোদন, উপকরণ বিতরণ এবং চাষাবাদ কার্যক্রম বাস্তবায়নে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাধীন এলাকায় আঞ্চলিক কার্যালয় এবং অন্যান্য এলাকায় উপ-পরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর তত্ত্বাবধানে ব্লকের এসএএও, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাগণ সম্পন্ন করবেন। প্রদর্শনী বাস্তবায়নে ব্রি/বিনা/গম-ভূট্টা গবেষণাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নতুন জাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিগত ৫ বছরের মধ্যে ছাড়কৃত/নিবন্ধনকৃত বিভিন্ন ফসলের জাত সমূহকে প্রাধান্য দিতে হবে। সমলয় চাষাবাদের আওতায় উৎপাদিত মানসম্পন্ন বীজ উপযুক্ত মূল্যে ক্রয় করে পরবর্তী মওসুমে তা সমলয়ভূক্ত নতুন কৃষকের মাঝে বিতরণ করা যেতে পারে। সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতিকে টেকসই করার লক্ষ্যে প্রতি উপজেলায় প্রশিক্ষিত দক্ষ আধুনিক কৃষি যন্ত্রচালক গ্রুপ তৈরি করতে হবে যারা স্থানীয়ভাবে যন্ত্র চালনা ও মেরামত কাজে সহায়তা করবে।

সমলয় চাষাবাদে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ট্রেতে ম্যাটটাইপ ধানের চারা উৎপাদন। এ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি না করে পলিথিন অথবা ফ্লেক্সিবল ট্রেতে চারা তৈরি করা হয়। এজন্য রোপণের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন তারিখে বীজ বপণ করতে হয়। এতে ৩ঃ২ অনুপাতে মাটি ও গোবরের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। এরপর বীজ ছিটিয়ে পুনরায় অর্ধেক মাটি ও গোবর মিশ্রণ দিয়ে সমতল জায়গায় রেখে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। বীজতলা তৈরির ৩ দিনের মধ্যে অঙ্কুর বের হয়। যদিও ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদন কৃষকদের কাছে কিছুটা জটিল বলে মনে হয়। তবে সমন্বিত উদ্যোগে সফল ভাবেই ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদন করা সম্ভব। বীজের অঙ্কোরদগম ক্ষমতা ৮০ ভাগের কম হলে প্রয়োজনমত অতিরিক্ত বীজ ট্রেতে ফেলতে হবে।

ট্রেতে বীজ বপণের পূর্বে এ্যাজোক্সিট্রবিন অথবা পাইরাক্লোস্ট্রবিন গ্রূপের ছাত্রাকনাশক যেমন: এমিস্টারটপ অথবা সেলটিমা (প্রতি কেজি বীজের জন্য ২-৩ মিলি/লিটার) দিয়ে ১৮-২০ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে জাগ দিতে হবে। প্রতি ট্রেতে জাত অনুসারে ১২০-১৪০ গ্রাম বীজ বপণ করতে হবে। বীজ এমনভাবে ফেলতে হবে যাতে প্রতি সেন্টিমিটারে ২-৩টি চারা থাকে। ট্রের চারায় রোগবালাই দেখা দিলে এমিস্টারটপ অথবা সেলটিমা ২-৩ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার পর আনুমানিক ০৬ ঘন্টা ট্রে-তে সেচ দেয়া যাবে না। সমভাবে বীজ ছিটানোর পর হালকাভাবে এক স্তর মাটি দিতে হবে। বেশী পুরু করে মাটি দেয়া যাবে না। বোরো মওসুমে ২৫-৩০ দিনের চারা এবং আউস ও আমন মওসুমে ১৫-২০ দিনের চারা রোপণ করতে হবে। অর্থাৎ চারার উচ্চতা আনুমানিক ১৫ সেমি হতে হবে। এই পদ্ধতিতে ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে চারা বেড়ে ওঠে। পরে রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মাধ্যমে চারা রোপণ করা হয়। তবে হাতে রোপণ করলেও সারিবদ্ধভাবে চারা রোপণ করতে হবে যেন আন্ত:পরিচর্যা সহজ হয়।

বর্তমানে আমাদের দেশের কৃষকরা অভিযোগ করেন যে ধান চাষ লাভজনক নয়। এটিকে লাভজনক করার অন্যতম উপায় হলো উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা। আর উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে হলে সমলয় চাষের বিকল্প নেই। প্রচলিত পদ্ধতিতে এক হেক্টর জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে এলাকাভেদে খরচ হয় প্রায় ১২-১৬ হাজার টাকা, যেখানে রোপণ যন্ত্র ব্যবহার করলে ব্যয় হয় মাত্র ৩-৩.৫ হাজার টাকা। একই ভাবে ধান কর্তনের ক্ষেত্রেও সময় স্বল্পতা এবং সারাদেশে প্রায় পাশাপাশি সময়ে কর্তন কাজ শুরু হওয়ায় শ্রমিকের ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে একটি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কর্তনে যেখানে হেক্টর প্রতি ৩.৫-৪ হাজার টাকা খরচ হয় সেখানে শ্রমিক দিয়ে কর্তন, পরিবহণ, মাড়াই এবং ঝাড়াই বাবদ এলাকাভেদে প্রায় ১৮-২০ হাজার টাকা খরচ হয়। এই হিসেবে শুধুমাত্র রোপণ এবং কর্তনে যান্ত্রিকীকরণ করা সম্ভব হলে ধান উৎপাদন খরচ হেক্টর প্রতি প্রায় ২৫-২৮ হাজার টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।

এ ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক এমপি সম্প্র্রতি এক কর্মশালায় বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করতে নিরলস কাজ করছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নেয়া হয়েছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প। পাশাপাশি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত করতে দক্ষ জনবল তৈরিতে এরই মধ্যে মাঠপর্যায়ে কৃষি প্রকৌশলীর ২৮৪টি পদ সৃজন করা হয়েছে। ফলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষেতগুলো ছোট ছোট। তাছাড়া কৃষকরা বিভিন্ন জমিতে বিভিন্ন সময়ে চারা রোপণ করেন। ফলে কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার সঠিকভাবে করা যায় না। সমলয় পদ্ধতিতে চাষ করলে যন্ত্রের ব্যবহার সহজতর হবে। কৃষকের সময় ও শ্রম খরচ কমবে। কৃষক লাভবান হবেন।

লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ই-মেইল: smmomin80@gmail.com

This post has already been read 5135 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …