ডা. মো. রোমেল ইসলাম (ডিভিএম) : মুরগিকে যদি একটি ডিম উৎপাদনের মেশিন ধরা যায় তবে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১২০ গ্রাম সুষম খাদ্য খেয়ে ৬০ গ্রামের একটি সুষম ও সুস্বাদু ডিম তৈরি করে। সরল চোখে দেখলে খামারি ও মুরগীর সম্পর্ক দৃষ্টিগোচর মনে হলেও , এ আর তেমন কি ব্যাপার! কিন্তু একটি ডিম উৎপাদন করতে গিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়োজন করতে হয়, যেখানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শ্রেণীর পেশাজীবি পরিবার সম্পৃক্ত। ফিডমিলে খাদ্য উৎপাদন থেকে পাড়ার মুদি দোকানে ডিম সরবরাহ পর্যন্ত এই কর্মযজ্ঞের আয়োজন চলে। দিনশেষে ভোক্তা সাধারণ একটা ডিম ক্রয় করেন ৭ – ৮ টাকায় যেখানে একজন প্রান্তিক খামারির একটি ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ে প্রায় ৬.২৫ টাকা। অথচ গত একমাস আগেও যার উৎপাদন খরচ ছিল প্রায় ৫.৭৫ টাকা।
করোনা অতিমারীর প্রথম দফার লোকসান সামলে উঠতে না উঠতেই আবারও দ্বিতীয় দফায় বড় লোকসানের মুখে প্রান্তিক খামারিরা। দফায় দফায় লকডাউনে পোল্ট্রী পণ্যের চাহিদা যেমন দিন দিন কমছে, সেইসাথে কমে যাচ্ছে বাজার দর। অন্যদিকে পোল্ট্রী খাদ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
গত এক সপ্তাহ আগেও একটি ব্রয়লার মুরগির বাজার দর কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা থাকলেও বর্তমানে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা যেখানে উৎপাদন খরচ ১৩০ টাকার বেশি। পোল্ট্রী খাতে করোনা অতিমারীর প্রথম ধাপের বিরূপ প্রভাব বর্তমানে দেখা দিয়েছে। কারণ, ৬০ – ৭০ শতাংশ আমদানি নির্ভর পোল্ট্রী খাদ্যের কাঁচামাল, ভিটামিন, মিনারেল প্রিমিক্স ও ঔষধ যেসব দেশ হতে আমদানি হয় তারাও করোনায় বিপর্যস্ত, তাদের কৃষি উৎপাদনেও করোনার থাবা, সেইসব দেশের রপ্তানি স্থবির যার প্রভাব ও অস্থিরতা আমাদের পোল্ট্রী শিল্পে বর্তমানে বিরাজমান। ফলে ক্রমেই বাড়ছে খামারি নামক প্রোটিন সৈনিকদের আর্তনাদ।
করোনায় বিধিনিষেধ আরোপে একদিকে যেমন জনগণের ক্রয়ক্ষমতা দিন দিন ক্রমহ্রাসমান অন্যদিকে ডিম ও মাংসের চাহিদা কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। পোল্ট্রী পণ্যের কাঁচামাল খালাসে বন্দরে চলছে দীর্ঘসূত্রিতা। ফলস্বরূপ, দফায় দফায় বাড়ছে উৎপাদন খরচ। পোল্ট্রী পণ্য পরিবহনে যানবাহন সড়কে চলাচলে নিত্যদিন চাঁদাবাজি ও হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব অভিযোগ স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক খামারির যার প্রভাব এসে পড়ে ডিমের উৎপাদন খরচের উপর। জনসাধারণকে পোহাতে হয় দুর্ভোগ আর খামারি বঞ্চিত হয় তার ন্যয্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে।
গতবারের কোভিডের ক্ষতি পুষিয়ে উঠার জন্য সরকার নগদ অর্থ প্রণোদনা ঘোষণা করে খামারিদের প্রদান করে। যদিও ক্ষতির তুলনায় নামমাত্র অর্থ সঠিক যাচাই বাছাই এর অভাবে সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত অনেক খামারির হাতে সেটি পৌঁছায়নি। প্রান্তিক খামারিদের ঝড়ে পড়া ঠেকাতে প্রণোদনা শুধু এককালীন অর্থ সাহায্য যথেষ্ট নয়, এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিপূরণ ও পূণরায় খামার সচল রাখার জন্য খামারিপ্রতি নগদ মুরগির বাচ্চা, খাদ্য ও ঘর মেরামতের সরঞ্জাম দেয়া যেতে পারে। এর ফলে ছোট ছোট খামারিরা পূণরায় খামার করতে উৎসাহ পাবেন এবং বাজারে প্রোটিনের সরবরাহ নিরবিচ্ছন্ন থাকবে। বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে সরকার খোলা বাজারে ইতিমধ্যে ডিম দুধ মাংস বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা প্রশংসার দাবী রাখে। করোনা অতিমারীর এই দুঃসময়ে জনসাধারণের উচিত নিয়মিত ডিম, দুধ ও মাংস খাদ্য তালিকায় রাখা। আর এর জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারনার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
আসুন, আমরা করোনাকে রুখতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবারের প্রত্যেকে ডিম, দুধ ও মাংস গ্রহণ করি। ভালো থাকুক প্রতিটি পরিবার, সুস্থ হয়ে উঠুক আগামী দিনগুলো।