ড. মো. শামছুল আলম১ ও মো. নাজমুল হাসান মেহেদী২ : লেবু বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সমাদৃত ভিটামিন সি সমৃদ্ধ টক জাতীয় ফল। স্বাদ, গন্ধ, পুষ্টিমান এবং ঔষধি গুণাগুণের ভিত্তিতে টক জাতীয় ফলের মধ্যে লেবু অন্যতম। লেবু প্রতিদিন খাওয়ার সাথে এবং অন্যান্য কাজে, প্রয়োজনীয় এবং অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। গরমের দিনে তৃঞ্চা নিবারণের ক্ষেত্রে লেবুর ‘সরবত’ অদ্বিতীয় পানীয়। দেশের প্রায় সর্বত্রই লেবুর চাষ হয়। বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, বৃত্তর ময়মনসিংহ, ঢাকার ধামরাই এবং মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় প্রচুর পরিমাণে লেবু উৎপন্ন হয়। দেশে লেবুর অত্যাধিক চাহিদা এবং উন্নত জাতগুলো বছরব্যাপী উৎপাদিত হয় বিধায় লেবু এদেশে একটি সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে।
উদ্ভাবনের ইতিহাস
ভারতের একটি স্থানীয় জাত হতে বিনালেবু-২ এর জার্মপ্লাজমটি সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত জার্মপ্লাজমটি বিনা‘র প্রধান কার্যালয়সহ উপকেন্দ্রসমূহে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে CL-1 নামক কৌলিক সারিটি সনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত সারিটির লেবু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফলন সন্তোষজনক হওয়ায় জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ২০২০ সালে সারিটিকে “বিনালেবু-২” নামে নিবন্ধন করে কৃষক পযায়ে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন দেয়।
বৈশিষ্ট্যাবলী
– ফল ডিম্বাকৃতি থেকে সিলিন্ডাকৃতির, ফলের অগ্রভাগ সূচাঁলো, বহিরাবণ মাঝারি মসৃণ এবং সুগন্ধিযুক্ত।
– পরিপক্ক অবস্থায় কিছু ফলের ৩ থেকে ৪ টা বীজ থাকে কিন্তু অধিকাংশই বীজ শূন্য।
– ফলের ওজন ১৩০-১৭০ গ্রাম।
– ফলের চামড়ার পুরুত্ব ০.৩৫-০.৪৫ সে.মি.।
– ফলে ভিটামিন সি এর পরিমান ৩০ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম এবং রসের পরিমাণ খুব বেশী,৩১-৩৫%। রসে এসিডের পরিমাণ ৫.১%।
– কলমের চারা রোপনের সময় থেকে ১১ মাসের মধ্যে ১ম ফলন পাওয়া যায়।
– এক বছরের একটি গাছে ১৩০-১৭০ টি ফল পাওয়া যায়।
– উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এ জাতের ফলন ৩৫-৫০ টন/হেক্টর পাওয়া যায়।
প্রচলিত জাতের তুলনায় বৈশিষ্ট্য
বিনালেবু-২ লেবুর ফলন প্রচলিত জাতের তুলনায় বেশী এবং প্রায় সারা বছরব্যাপী লেবু পাওয়া যায়, লেবু সুগন্ধিযুক্ত।
জলবায়ু
লেবু উষ্ণ ও অবগ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের ফসল। সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে লেবু ভাল জন্মে। লেবু গাছের বৃদ্ধি ও ফল প্রদানের জন্য ২৫-৩০০ সে. তাপমাত্রা উপযোগী। তবে ২৯০ সে. তাপমাত্রায় ফলের পরিপক্কতা, গুণাগুণ ও খোসার রং ভালো হয়। ১৩০ সে. তাপমাত্রার নীচে ও ৩৮০ সে. তাপমাত্রার উপরে গেলে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। লেবু চাষের জন্য ১২৫-১৮৫ মি.মি. বৃষ্টিপাত উপযুক্ত। তবে সুষমভাবে বৃষ্টিপাত হলে ৭০ মি.মি. বৃষ্টিপাত সন্তোষজনক বলে মনে করা হয়।
মাটি ও মাদা তৈরি
লেবু হালকা দোআঁশ ও নিষ্কাশন সম্পন্ন মধ্যম অম্লীয় মাটিতে ভাল হয়। বিনালেবু-২ সাধারনত মাটির অম্লক্ষারত্ব ৫.৫-৭.৫ হলে সবচেয়ে ভাল হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে হলে জমি গভীরভাবে চাষ দিয়ে আগাছা ভাল ভাবে পরিস্কার করে জমি তৈরি করতে হয়। চারা রোপণ করার ১৫-২০ দিন পূর্বে ২.৫ x ২.৫ বা ৩ x ৩ মিটার দুরত্বে ৫০-৭৫ সে.মি. x ৫০-৭৫ সে.মি. আকারের গর্ত করতে হবে। গর্ত করার সময় পুরো উপরের অর্ধেক মাটি নীচে দিতে হবে এবং নীচের অর্ধেক মাটি গর্তের উপরে দিতে হবে। এবার গর্তের উপরের মাটির সাথে প্রতি গর্তে ২০ কেজি গোবর অথবা জৈব সার, ৩০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ২০০ গ্রাম জিপসাম ও ৩০ গ্রাম বোরণ সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে তাতে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। স্যাঁতস্যাতে, লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে লেবু ভালো হয় না। তবে মাটি অধিক অম্লীয় হলে হেক্টর প্রতি ১ টন অথবা গর্ত প্রতি ১.৫ কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে। উল্লিখিত রোপণ দূরত্ব হিসাবে প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১১১১-১৬০০ টি চারা দরকার হয়।
বংশ বিস্তার
কাটিং, গুটিকলম ও জোড়কলমের মাধ্যমে বিনালেবু-২ এর বংশবিস্তার করা যায়। কলম করার উপযুক্ত সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। তবে এগ্রাসেড দ্বারা তৈরীকৃত পলি হাউজে কলম করলে অমৌসুমেও সফলভাবে কলম করা যায়। অযৌন পদ্ধতিসমূহের মধ্যে গুটি কলমের মাধ্যমে তৈরীকৃত চারা দ্রুত ফল দেয়।
রোপণ পদ্ধতি ও রোপণের সময়
লেবুর চারা সারি, বর্গাকার এবং ষড়ভূজ প্রণালীতে রোপণ করলে বাগানে আন্তঃপরিচর্যা ও ফল সংগ্রহ সহজ হয়। পাহাড়ী ঢালু জমিতে আড়াআড়ি ভাবে লাইন করে চারা রোপণ করলে মাটির ক্ষয়রোধ হয়। গুটি কলম, জোড় কলম ও কাটিং এর মাধ্যমে তৈরীকৃত চারা এপ্রিল থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত লাগানো যায় তবে সেচ সুবিধা থাকেলে সারা বছর চারা লাগানো যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে আবহাওয়া যেন শুষ্ক থাকে এবং গর্তে কোন পানি জমে না থাকে।
চারা/কলম রোপণ ও পরিচর্যা
মাদা তৈরী করার ১৫-২০ দিন পর চারা বা কলম রোপণ করতে হয়। গর্তের ঠিক মাঝখানে খাড়াভাবে চারা রোপণ করতে হবে এবং চারদিকের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালভাবে বসিয়ে দিতে হবে। তারপর চারাটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে এবং চারার গোড়ায় ঝাঁঝড়ি দিয়ে পানি দিতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
চারা রোপণের পর ভাল ফলন পেতে হলে নিয়মিতভাবে সার প্রয়োগ করতে হবে। নিম্নে বয়স অনুপাতে প্রতি গাছের জন্য সারের পরিমান দেওয়া হলো:
গাছের বয়স (বছর) | সারের নাম ও পরিমাণ | |||
পঁচা গোবর (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) | |
১-২ | ২০ | ৩০০ | ৩০০ | ৩০০ |
৩-৫ | ২৫ | ৪৫০ | ৪০০ | ৪০০ |
৬ এবং তদুর্ধ | ৩০ | ৫০০ | ৪৫০ | ৪৫০ |
উল্লেখিত পরিমাণ সার চারা রোপণের তিন মাস পর হতে সমান তিন কিস্তিতে গাছের গোড়া হতে ২০-৪০ সে.মি. জায়গা বাদ দিয়ে চতুর্দিকে ছিটিয়ে কোদাল দ্বারা কুপিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। দুপুর বেলায় যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ঠিক ততটুকু জায়গা পযন্ত সার দিতে হবে। প্রম কিস্তি মাঘ-ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি) মাসে যখন ফল ধরা শুরু হয়, দ্বিতীয় কিস্তি বর্ষার প্রারম্ভে বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ (মে-জুন) মাসে, এবং তৃতীয় কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবার সার প্রয়োগের পর পরই একটু হালকা পানি সেচ দিতে হবে যাতে করে সার মাটির সাথে মিশে যেতে পারে। তাছাড়া লেবু গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতি বছরই সারের পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি করতে হবে।
আগাছা দমন
গাছের পর্যাপ্ত বৃদ্ধি ও ফলনের জন্য সবসময় জমি পরিষ্কার বা আগাছামুক্ত রাখতে হবে। বিশেষ করে গাছের গোড়া থেকে চারদিকে ১ মিটার পর্যন্ত জায়গা সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
পানি ও সেচ নিষ্কাশন
চারা রোপণের পর ঝরণা দ্বারা বেশ কিছু দিন পর্যন্ত পানি সেচ দিতে হবে। সর্বোচ্চ ফলনের জন্য ফুল আসা ও ফলের বিকাশের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকা আবশ্যক। এ জন্য খরা মৌসুমে লেবু বাগানে সেচ দেওয়া প্রয়োজন। বর্ষাকালে গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমতে না পারে সেজন্য বৃষ্টি ও সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
অঙ্গ ছাঁটাই
গাছের গোড়ার দিকে জল-শোষক শাখা বের হলেই তা কেটে ফেলতে হবে। এছাড়া গাছের ভিতরের দিকে যে সব ডাল পালা সূযের আলো পায় না সেসব দুর্বল ও রোগাক্রান্ত শাখা-প্রশাখা নিয়মিত ছাঁটাই করে দিতে হবে। সাধারনত মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) পর্যন্ত অঙ্গ ছাঁটাই করার উপযুক্ত সময়। ছাঁটাই করার পর কর্তিত স্থানে বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে যাতে ছত্রাক আক্রমণ না করতে পারে।
লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা১, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা২
গাছের চারা পেতে এবং বিস্তারিত আরো জানতে : ড. মো. শামছুল আলম, ঊর্ধধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিনা। মোবাইল: ০১৭১১১২৪৭২২