মোহা. আবুল কালাম আজাদ : জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO : Food & Agriculture Organization) সারা বিশ্বের জনগণের মধ্যে দুগ্ধকে গ্লোবাল ফুড হিসেবে পরিচিত করার জন্যই মূলতঃ ২০০১ সনে সর্বপ্রথম বিশ্ব দুগ্ধ দিবস (World Milk Day) পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যার ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (১ জুন) পালিত হতে যাচ্ছে ‘২২তম বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২১’। বরাবরের ন্যায় Sustainability in the dairy sector along with empowering the environment, nutrition and socio-economic প্রতিপাদ্য বিষয়ে এবারের বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ’২০২১ বিষয় হচ্ছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বাংলাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদযাপিত হবে, যেখানে সরকারের মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ, ডেইরি ফার্ম/ডেইরি ব্যবসায়ী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোপরি বাংলাদেশস্থ FAO প্রতিনিধি, বিভিন্ন দূতাবাসসমুহ সরাসরি এই কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করে থাকে।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭১-৭২ সালে রেকর্ডদৃষ্টে কাঁচা তরল দুধের সর্বমোট উৎপাদন ছিল মাত্র ১০ লাখ মেট্রিক টন এবং দুধের প্রাপ্যত্য ছিল ১৯৭০-৮০ দশকে জনপ্রতি মাত্র ৩০ মিলি.। কালের পরিক্রমায় কাঁচা দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬ হতে ১৫ গুণ পর্যন্ত ; স্থিরিকৃত জিডিপি মাণদন্ডে জাতীয় পর্যায়ে এই খাতের অবদান প্রায় ১.৪৩% এবং প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৪.০০% । বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষভাবে এবং ৫০% পরোক্ষভাবে অমিত সম্ভাবনাময় প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। ২০১৯- ২০ আর্থিক বৎসরে এদেশে দুধের মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন এবং যার বিপরীতে চাহিদা ছিল ১ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার মেট্রিক টন। অপরদিকে ২০১০ -১১ আর্থিক বছরে দুধের মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ২৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন এবং চাহিদা ছিল ১ কোটি ৩৫ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন। বিগত এক দশকের ব্যবধানে দুধের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ১৭ লাখ মেট্রিক টন এবং উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭৭ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন । অর্থাৎ, গত ১০ বছরে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩.৫ গুণ।
বাংলাদেশে দুগ্ধ উৎপাদন,উৎপাদিত কাঁচা তরল দুগ্ধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ভ্যালু অ্যাডিশন সর্বোপরি প্রান্তিক পর্যায়ে বাজারজাতকরণে দেশের সর্ববৃহৎ দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল যাবৎ এক গৌরবজ্জল ভূমিকা রেখে চলেছে। ভারতের বিশ্বখ্যাত আমুল মডেলের মাধ্যমে (বর্তমানে মিল্ক ভিটা মডেল নামে খ্যাত) সারা দেশের প্রায় ৬৪টি উপজেলায় মিল্ক ভিটার মাধ্যমে লাখ লাখ সমবায়ী তাঁদের খামারে উৎপাদিত দুগ্ধ উৎপাদন করে সেগুলো মিল্ক ভিটার নিকট সমবায়ী চেতনায় বিক্রয় করছেন এবং নিজেদের ভাগ্যের প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছে । মিল্ক ভিটা প্রতিদিন ৩৭৫ লিটার দুগ্ধ সংগ্রহের মাধ্যমে তার কার্যক্রম শুরু করেছিল, বর্তমানে গড়ে দৈনিক দুগ্ধ সংগ্রহের পরিমান প্রায় ১ লাখ ৭৫হাজার লিটার। তাছাড়া অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আড়ং ডেইরি, প্রাণ ডেইরি, শিলাইদহ ডেইরি; ইগলু ডেইরি নামক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এই সেক্টরে যথেষ্ট অবদান রেখে চলেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ডেইরি ব্যবসা একটি নন্দিত পেশা হিসাবে শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত, অশিক্ষিত এবং নতুন /পুরাতন উদ্যোক্তাদের নিকট বিশেষ মর্যদায় ইতিমধ্যেই স্থান করে নিয়েছে। এদেশে অনেক হাইটেক বৃহৎ ডেইরি খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (ডাচ ডেইরি, ইয়ন ডেইরি ,আন্ধারুর মোড় ডেইরি প্রভৃতি)। যার মাধ্যমে দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা নিরসনসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এক ইতিবাচক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- এককালের মঙ্গাপীড়িত জনপদ হিসেবে পরিচিত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় (নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা) ব্যাপকহারে ধানের জমির পাশাপাশি ভুট্টার চাষ হচ্ছে। এর মাধ্যমে গবাদিপ্রাণিকূলের দানাদার খাবার, কাঁচা ঘাসের বাৎসরিক চাহিদা মেটানো হচ্ছে। এখান হতে উৎপাদিত কাঁচা সবুজ ঘাসের বিকল্প হাইটেক সাইলেজ (Silage) বাণিজ্যিকভাবে দেশের বিভিন্ন জেলার চাহিদা মেটাচ্ছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উৎপাদিত হাইটেক সাইলেজ সারাদেশে বাজারজাত হচ্ছে।
উইকিপিডিয়া মোতাবেক তালিকাভূক্ত বিশ্বের ১৭৭টি দেশের মধ্যে তরল দুগ্ধ পান করার মানদন্ডে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণ জনপ্রতি বাৎসরিক মাত্র ২১.৯১ লিটার দুগ্ধ পান করে থাকেন( জনপ্রতি দৈনিক ৬০মিলি.)। অপরদিকে দুগ্ধ পানে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড (বাৎসরিক জনপ্রতি গ্রহণের পরিমান ৪৩০ লিটার বা দৈনিক জনপ্রতি ১.১৭ লিটার)। সার্কভূক্ত দেশের মধ্যে পাকিস্তান বছরে জনপ্রতি ১৮৩.১৩ লিটার বা দৈনিক ৫০১.৭১ মিলি., ভারত বছরে জনপ্রতি ৮৪.৫০ লিটার বা দৈনিক ২৩১.৫০ মিলি., আফগানিস্তান বছরে জনপ্রতি ৬২.২৩ লিটার বা দৈনিক ১৭০.৪৯ মিলি., নেপাল বছরে জনপ্রতি ৫২.১০ লিটার বা দৈনিক ১৪২.৭৩ মিলি., শ্রীলংকা বছরে জনপ্রতি ৩৪.৯৮ লিটার বা দৈনিক ৯৮.৮৩ মিলি.।
উপরোক্ত তথ্যের মাধ্যমে স্পষ্টতই বোঝা যায়, বাংলাদেশে দুগ্ধ উৎপাদন, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের কতটা বিপুল পরিমান সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, প্রযুক্তির ক্রম উন্নয়ন, ডেইরি সংগঠন ইত্যাদির কারণে এই দেশে অবসম্ভাব্যভাবীভাবে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধি হবে বলে বোদ্ধাজনেরা আশাবাদি। সম্প্রতি দেশে পাস্তুরিত তরল দুধের পাশাপাশি অন্যান্য দুগ্ধপণ্য সামগ্রী যেমন- টক দধি, লাবাং, বাটার, ঘি, পনির ব্যবহার জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ সংকটকালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তারা খামারে উৎপাদিত দুগ্ধ সংগ্রহপূর্বক বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করেছেন। যার মাধ্যমে নতুন নতুন আইডিয়া বাস্তবে রুপদানের জন্য খামারীগণ সচেষ্ট হচ্ছেন।
এক গ্লাস পানযোগ্য দুধের মূল্য গড়ে কম/বেশি দশ টাকা মাত্র হতে পারে। দুগ্ধ পানের অভ্যাস গঠনের মাধ্যমে এই শিল্পকে বহুদূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। দুগ্ধ পানের এই অভ্যাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিকট হতে শুরু হতে পারে। যেখানে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস যখাযোগ্যভাবে পালন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং মিল্ক ভিটার যৌথ আর্থিক সহযোগীতায় ইতিপূর্বে পরিচালিত সফল একটি প্রোজেক্ট ছিল School Milk Feeding Program এর আদলে সরকারি পর্যায়ে প্রকল্প গ্রহণ করার মাধ্যমে এক নব দিগন্তের সূচনা করা যেতে পারে। পাশাপাশি চলমান কার্যক্রমকে আরোও বেগবান করতে হবে। সরকারের প্রন্তিক পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ খাতকে অধিতকর বেগবানকরনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য জনবলের ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি । সর্বোপরি সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় দেশের অবশিষ্ট প্রায় ৪০০টি উপজেলায় মিল্ক ভিটার কায়ক্রমকে বিস্তৃত করলে এই খাতের দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে মনে করি।
লেখক: ডেইরি এক্সপার্ট, মিল্ক ভিটা।
Ref : DLS, Milk Vita, Internet, etc.