ডা. বিমল চন্দ্র কর্মকার : যুগ যুগ ধরে একটি পুষ্টিকর খাবার হিসাবে মানুষ দুধ পান করে আসছে। সাধারনভাবে ধরে নেয়া হয় দুধে মানব শরীরের জন্য সকল ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকে, তাই দুধকে একটি আদর্শ খাবারও বলা হয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীকূল জন্মের পর বিভিন্ন মেয়াদে শারীরিক গঠন, বৃদ্ধি সাধন ও রোগ প্রতিরোধের জন্য নিজ নিজ মায়ের দুধ পান করে থাকে। মানুষই একমাত্র ব্যতিক্রম। জন্মের পর মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি মানুষ গবাদিপশুর দুধ বিশেষ করে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি প্রাণিজ দুধ পান করে থাকে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের তথ্যমতে, একজন মানুষের গড়ে ২৫০ মিলি দুধ খাবার লক্ষমাত্রার বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে দৈনিক ১৭৫ মিলি দুধ পান করছে। এ বিভাগের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় দেশে দুধ উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ধারণা করা যায়, উৎপাদনের এ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু সমস্যা হলো দুধ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা থাকায় অনেকেই দুধ খেতে চায়না। আবার অনেকে মনে করে দুধ শুধুমাত্র শিশু এবং বয়স্কদের জন্য দরকার। কেউ কেঊ ভাবে দুধ খেলে বিভিন্ন ধরণের এলার্জিক রিঅ্যাকশন হতে পারে তাই তারা দুধ খাওয়ার প্রতি উদাসীন। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষিত লোকদের মধ্যে দুধের প্রতি উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। FAO এর বিশ্লেষনে উঠে এসেছে যে, শুধু প্রাণিসম্পদ সেক্টরের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার (SDG) এর সবকটি লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। আবার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুধের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে এসকল লক্ষ্যকে অর্জন করতে হলে পোল্ট্রি ও দুগ্ধ শিল্পের সামষ্টিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি জরুরি।
১ জুন বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। ২০২১ এর এ দিবস উপলক্ষে দুধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুধের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করা হলো।
খাদ্যের সবকটি (০৬টি) উপাদানই দুধে বিদ্যমান রয়েছে বলে দুধকে আদর্শ খাদ্য বলা হয়ে থাকে। দুধ (Whole milk) যে সকল খাদ্য উপাদান দ্বারা গঠিত তার প্রায় ৮৮% পানি। বাকী উপাদান সমুহের মধ্যে প্রায় ৩.৫% প্রোটিন, ৩.৮% ফ্যাট ও ৪.৭% কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। এছাড়াও মানব দেহের উপকারী বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, ভিটামিন ও এনার্জি দুধ হতে পাওয়া যায়। বর্ণীত হিসাব মতে এক কাপ (২৪০ মিলি ৩.২৫% ফ্যাট যুক্ত) দুধে প্রায় ১৪৬ ক্যালোরি শক্তি, ৮ গ্রাম প্রোটিন, ৮ গ্রাম ফ্যাট, ১১.৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে। তাছাড়া, একজন মানুষের দৈনিক যে পরিমান ভিটামিন ও মিনারেল দরকার তার ২৮% ক্যালসিয়াম, ২৪%ভিটামিন-ডি, ২৬% ভিটামিন বি-২, ১৮% ভিটামিন বি-১২, ১০% পটাসিয়াম এবং ১৩% সেলেনিয়াম এক কাপ দুধ হতে পাওয়া যায়। প্রয়োজনের বাকী অংশ দৈনন্দিন অন্যান্য খাবার হতে পাওয়া যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো কেনো দুধ খেতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে পরবর্তী আলোচনা করা হলঃ
দুধের কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrate)
দুধের কার্বোহাইড্রেট কে বলা হয় ল্যাকটোজ (Lactose)। গ্লুকোজ (Glucose) এবং গ্যালাকটোজ (Galactose) এ দুইটি কার্বোহাইড্রেট এর সমন্বয়ে ল্যাকটোজ গঠিত। সাধারণত দুধের ল্যাকটোজ পাকস্থলীর ল্যাকটেজ এনজাইম দ্বারা গ্লুকোজ ও গ্যালাকটোজ নামক কার্বোহাইড্রেটে পরিণত হয় এবং সহজে হজম হয়। USDA এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় 7৫% মানুষ, যাদের পাকস্থলীতে ল্যাকটেজ এনজাইম এর ঘাটতি রয়েছে তারা দুধ হজম করতে পারেনা। যার ফলে ল্যাকটোজ সরাসরি বৃহদন্ত্রে চলে যায় এবং পেটে বদহজম, ডায়রিয়া ও বমির উদ্রেক করে। এই ধরনের সমস্যাকে বলা হয় ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সি।
এখন প্রশ্ন হলো যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সি আছে তারা কি দুধ বা দুধ জাতীয় পণ্য খেতে পারবে না? এর উত্তর হলো-অবশ্যই পারবে। তবে এক্ষেত্রে সরাসরি দুধের (Whole milk) পরিবর্তে তারা দই (Yogurt) এবং পনির (Cheese) খেতে পারে। কারণ, পনিরে খুব কম পরিমান ল্যাকটোজ থাকে যা শরীরে কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি ছাড়াই হজম হতে পারে এবং দই এর মধ্যে ব্যাক্টেরিয়াল ল্যাকটেজ থাকায় দই এর ল্যাকটোজ সহজে হজম হয়।
দুধের আমিষ (Milk Protein)
ক্যাজিন (Casein) ও হোয়ে প্রোটিন (Whey protein) নামে দুই প্রকার প্রোটিন দুধে রয়েছে। সাধারণত দুধে ৮০% ক্যাজিন এবং ২০% হোয়ে প্রোটিন থাকে। । দুধের হোয়ে প্রোটিনে পর্যাপ্ত পরিমানে মিনারেল যেমন ক্যালসিয়াম থাকে। ক্যাজিনে প্রধানত আলফা, বিটা এবং কাফফা ক্যাজিন নামে বিভিন্ন প্রোটিন ছাড়াও আলফা ল্যাকটোগ্লোবিউলিন, বিটা ল্যাক্টোগ্লবিউলিন, লাক্টোফেরিন, ইম্মিউনোগ্লোবিউলিন (Immunoglobulin), সিরাম আলবুমিন এবং বিভিন্ন এনজাইম ও গ্রোথ ফ্যাক্টর বিদ্যমান। তাছাড়া, ক্যাজিন এবং whey protein দেহের ইনসুলিন নিঃসরন বাড়িয়ে কার্বোহাইড্রেট বা গ্লুকোজ মেটাবোলিজমে সাহায্য করে। এ প্রক্রিয়ায় মানুষের মেটাবলিক রোগ বিশেষ করে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে দুধের প্রোটিন গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া, ইম্মিউনোগ্লোবিউলিন দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বর্তমান করোনা মহামারীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষে নিয়মিত দুধ পান করা যেতে পারে। দুধের প্রোটিন বেশি খাবার খাওয়ার প্রবনতা কমিয়ে দেয় যার ফলে শরীরে অতিরিক্ত ফ্যাট জমতে পারেনা এবং শরীর স্থূলকায় হওয়া হতে রক্ষা পায়।
দুধের এ্যামাইনো এসিড (Milk Amino Acid)
মিল্ক প্রোটিন যে সকল এমাইনো এসিড দ্বারা গঠিত তা শরীরের জন্য খুব উপকারী। মানবদেহের জন্য মোট ২০ টি এ্যামাইনো এসিড প্রয়োজন। এ ২০ টি এমাইনোএসিডের মধ্যে ০৯ টি এ্যামাইনো এসিড মানব দেহে তৈরি হয়না। এসকল এ্যামাইনো এসিড খাদ্য উপাদানের মাধ্যমে শরীরে সরবরাহ করতে হয়। এদেরকে এসেনশিয়াল এ্যামাইনো এসিড (Essential Amino Acid) বলা হয়। মুলতঃ শরীরের বৃদ্ধিসাধন, হজমে সহায়তা, শক্তি উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এ সকল এমাইনোএসিড সহায়তা করে থাকে। আশার বিষয় হলো দুধ পান করেই একজন মানুষ এই এসেনশিয়াল এ্যামাইনো এসিডের ০৯ টি এ্যামাইনো এসিডই পেতে পারে। দুধের whey protein অংশে শাখাযুক্ত এ্যামাইনো এসিড (Branched Amino Acids) বেশি থাকে যা শরীরের চর্বি কমাতে, ওজন কমাতে ভূমিকা রাখে। হাইপারটেনশান কমাতেও মিল্ক প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
মিল্ক ফ্যাট (Milk Fat)
দুধে স্যাচুরেটেড এবং আন-স্যাসুরেটেড দুই ধরনের ফ্যাটি এসিড রয়েছে। আবার দুধে High Density Lipoprotein (HDL) এবং Low Density Lipoprotein (LDL) রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা হয় যে, যেহেতু দুধে বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যা ক্ষতিকর Low Density Lipoprotein (LDL) তৈরি করে, সেহেতু দুধ খেলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু, বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পাওয়া যায় যে, স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণের সাথে শরীরে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ হওয়ার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। কারণ, একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, স্যাচুরেটেড ফ্যাট শুধু ক্ষতিকর LDL তৈরি করেনা বরং শরীরের জন্য উপকারী HDL ও তৈরি করে থাকে এবং সকল LDL ক্ষতিকর নয়। বরং, গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন ৩০০ মিলি দুধ (Whole Milk) পান করলে শরীরে কোন ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়েনা। গবেষণায় আরও প্রকাশ হয়েছে যে যারা নিয়মিত দুধ বা দুগ্ধজাত পনীর গ্রহণ করে তাঁদের হৃদরোগ হবার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় কম। দুধের লিনোলেইক এসিড ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমন্বিতভাবে কাজ করে, যা ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ প্রতিরোধে কাজ করে।
দুধের মিনারেল (Milk Mineral)
দুধে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম, জিংক ইত্যাদি মিনারেল রয়েছে যা শরীরের জন্য অতীব উপকারী। মানব শরীরের ৯৯% ক্যালসিয়াম থাকে হাড় এবং দাঁতে। বাকী ১% রক্তে থেকে শারীরিক চাহিদা পুরণ করে। কোন কারণে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে হাড় হতে আনীত ক্যালসিয়াম এ ঘাটতি পুরণ করে। নিয়মিত খাদ্য আইটেমে দুধ থাকলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হবার সম্ভাবনা থাকেনা। অর্থাৎ বয়স্কদের ক্যালসিয়ামের ঘাটতি জনিত রোগ অস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis) এবং হাড় ভাঙ্গার সম্ভাবনা কমে যায়। দুধের ফসফরাস ভিটামিন-ডি ও ক্যালসিয়ামের সাথে কাজ করে হাড়ের গঠন ঠিক রাখে।
দুধের ভিটামিন (Milk Vitamin)
দুধে ভিটামিন-বি১ (Thiamin), বি২ (Rivoplavin), বি৫ (Pantothenic acid), বি১২ (Cobalamin) রয়েছে। তাছাড়া, ভিটামিন এ, ডি, ই, কে ইত্যাদি ভিটামিনও দুধে রয়েছে। সাধারণত দুধে ভিটামিন সি থাকেনা বা থাকলেও খুব কম পরিমান। দুধের ভিটামিন বি-১২ রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে এবং স্নায়ু কোসকে ঠিক রাখে। দুধের ভিটামিন-এ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং চামড়ার গুণাগুণ ঠিক রাখে।
কাঁচা দুধ (Raw milk) কি খাওয়া যাবে?
আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে এখনো এরকম ধারণা রয়েছে যে কাঁচা দুধ পান করলে বেশি পুষ্টি পাওয়া যায়, এ ভেবে কিছু কিছু খামারী, খামার কর্মী অথবা সাধারণ মানুষ কাঁচা দুধ পান করে থাকে। কিন্তু, মনে রাখা প্রয়োজন যে কিছু কিছু রোগের জীবাণু কাঁচা দুধে থাকতে পারে। এ সকল জীবাণু আক্রান্ত গরু এমনকি আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ গরুর শরীর থেকেও দুধে আসতে পারে। তাছাড়া, ঘরের মেঝে, দোহনকারীর হাত, গরুর ওলান, দুধের পাত্রে, দুধ দোহনকারী মেশিনের মাধ্যমে এ সকল জীবাণু দুধে সংক্রমিত হতে পারে। কাঁচা দুধ খেলে যক্ষ্মা (Tuberculosis), টাইফয়েড (Salmonelosis), কলিব্যাসিলসিস (Colibasilosis), ব্রুসেলসিস (Brucellosis) রোগ সৃষ্টি করা ছাড়াও বিভিন্ন জীবাণু মানব শরীরে প্রবেশ করিয়ে পেটের পীড়া ও বমির উপদ্রপ ঘটাতে পারে। কাজেই কাঁচা দুধ না খেয়ে পাস্তুরিত দুধ অথবা গরম করে জীবাণুমুক্ত দুধ খাওয়া উত্তম।
দুগ্ধ খামারে এন্টিবায়োটিক এর অপপ্রয়োগ বন্ধ করা জরুরি
দেশে দুধ উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো বেশিরভাগ খামারী তাদের প্রাণি চিকিৎসার জন্য স্থানীয় অদক্ষ গ্রাম্য চিকিৎসক বা কোয়াকের শরণাপন্ন হয়। যার ফলে একদিকে যেমন সঠিক চিকিৎসাসেবা হতে খামারী ও খামারের গাভী ও গরু বাছুর বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে এন্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ এবং যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে জীবাণুসমূহ এন্টিবায়োটিকের প্রতি রেসিস্টেন্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অর্থাৎ এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এন্টি মাইক্রোবিয়াল রেসিস্টেন্স (Anti-microbial Resistance-AMR)-কে ১০ টি প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকির তালিকায় স্থান দিয়েছেন। তাছাড়া, এসডিজি অর্জনের জন্য সকলকে সমন্বিত ভাবে কাজের পরামর্শ দিয়েছেন। কাজেই প্রাণিসম্পদ বিভাগকে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
তাহলে এক নজরে যে বিষয়গুলো সবাইকে জানতে এবং মানতে হবে তা হলো-
- সকলকে দুধ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তবে দুধ হতে হবে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত গরম অথবা পাস্তুরিত দুধ।
- যে সকল মানুষের দুধের ল্যাকটোজের প্রতি ইন্টলারেন্সি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে দই একটি বিকল্প দুগ্ধজাত পণ্য হতে পারে কারণ দইয়ের মধ্যে বেশি পরিমাণে প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া থাকে যা হজমে সহায়তা করে। তাছাড়া পনিরও একটি বিকল্প খাদ্য পণ্য হতে পারে।
- দুধের চর্বিতে ক্ষতিকর কোলেস্টরল-LDL এবং উপকারী কোলেস্টরল-HDL দুই প্রকারের কোলেস্টেরলই বিদ্যমান। গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত ৩০০ মিলি দুধ পান করলে হৃদরোগ হওয়ার কোন নজির নাই। বরং দুধের লিনোলেইক এসিড ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমন্বিতভাবে কাজ করে যা ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
- দুধের প্রোটিনে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরনের এ্যামাইনো এসিড এবং শাখাযুক্ত এ্যামাইনো এসিড বিদ্যমান যা মুটিয়ে যাওয়া (Obesity), ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
- যেহেতু দুধে ৮৮% পানি থাকে সেহেতু দুধ পান করলে দেহে পানিশূণ্যতা হয়না। চর্বির কারণে নিয়মিত দুধ পান করলে কোস্টকাঠিন্য প্রতিরোধ করা যায়।
- দুধের খনিজ শরীরের বৃদ্ধিসাধন, হাড় গঠন ও দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। দুধের ভিটামি-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-কে শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কার্যক্রমে ভূমিকা রাখে।
- দেশের দুগ্ধ শিল্পের সাথে খামারী, ভোক্তা, দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী, মিষ্টি ব্যবসায়ী, বিপণনকারী সবার সম্পৃক্ততা রয়েছে। করোনা মহামারীর সময়ে দুগ্ধ খামারীসহ সংশ্লিষ্ট সকলে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এ ক্ষতির মূল কারণ, প্রথম দিকে দুধের চাহিদা কম ছিল এবং দামও কমে গিয়েছিল। তাছাড়া মিষ্টি দোকান, চায়ের দোকান বন্ধ থাকায় দুধের ব্যবহার কমে গিয়েছিল। কিন্তু, যদি এমন একটি ব্যবস্থা থাকতো যার মাধ্যমে খামারীগণ তাদের দুধ সহজে বিক্রি করতো, জনগণের মধ্যে দুধ গ্রহণের প্রবনতা থাকতো এবং দুধ ছাড়াও দুগ্ধজাত পণ্য যেমন পনির, বাটার, দই, ঘি সচরাচর তৈরি হতো তাহলে খামারী পর্যায়ে সঠিক দাম পেতো, সাধারণ মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হতো, এবং করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতো।
- তাহলে, দুগ্ধ শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য শুধুমাত্র উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেই চলবেনা। বরং উৎপাদিত দুধে ভ্যালু যোগ (Value Addition) করার মাধ্যমে বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং তা সহজলভ্য করতে হবে। দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য বিপণনের যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মানুষের মধ্যে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে দুগ্ধ খামারে এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার/অপপ্রয়োগ রোধ করতে কোয়াক বা পল্লী চিকিৎসকদের নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আর এসব ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ বিভাগকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তবেই সাদা বিপ্লবের মাধ্যমে মেধাবী জাতির দেশ হবে বাংলাদেশ। পুষ্টি নিরাপত্তা ও এসডিজি’র লক্ষ্যসমূহ হবে বাস্তবায়নযোগ্য।
লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), কুমিল্লা।
ই-মেইল : karmakar_bimal@yahoo.com