ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : উপকূলীয় অঞ্চলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে জনজীবনে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এরপর করোনা পরিস্থিতি এবং সুপার সাইক্লোন আম্ফান ও ইয়াসের আঘাত সংকট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে ঝড় ও জলোজ্বাসে সংকট দেখা দিলেও এখন স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মঙ্গলবার (২৪ আগষ্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানে তারা এই দাবি জানান। নাগরিক সংগঠন ‘সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন’ এবং বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ‘ফেইথ ইন একশন’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক ফোরামের আহ্বায়ক সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি এমপি।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্রের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে বক্তৃতা করেন খুলনা-৬ আসনের মো. আক্তারুজ্জামান বাবু, বাগেরহাট-৪ আমনের মো. আমিরুল ইসলাম মিলন, পটুয়াখালী-৩ আসনের এস এম শাহজাদা এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সৈয়দা রুবিনা আক্তার (বরিশাল) ও অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার (খুলনা) প্রমুখ।
এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন ডিআরইউ সভাপতি মোরসালিন নোমনী, নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে, কেএনএইচ জার্মানির প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান মুকুল, ফেইথ ইন একশনের নির্বাহী পরিচালক নৃপেন বৈদ্য, স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা, উন্নয় সংগঠন লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল, সচেতন সংস্থার সাকিলা পারভীন প্রমূখ।
অনুষ্ঠানে উপকূলীয় জনপ্রতিনিধি সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি বলেন, শুধু জোয়ারের পানিতে উপকূলের নিম্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে তা নয়, সাতক্ষীরা শহরেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই টেকসই বেড়িবাঁধের পাশাপাশি পানি নিস্কাশন ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হবে।
সংসদ সদস্য আমিরুল আলম মিলন বলেন. আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণ ঘুণিঝড় সিডরের ক্ষত এখনো বহন করে বেড়াচ্ছে। আকাশে মেঘ দেখলেই ওই এলাকার জনমনে আতংক দেখা দেয়। এই আতংক থেকে রক্ষায় উপকূলে টেকসই বাঁধের পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।
সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে বেড়িবাঁধের ওপর। বাঁধের ক্ষতি হলে তাদের সবকিছু ভেসে যায়। বাড়িঘর নষ্ট ও ফসলের ক্ষতি হয়। তাই ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে জরুরি খাবার না দিয়ে, বাঁধটা শক্ত করে বানিয়ে দেওয়ার দাবিটাই প্রধান
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপকূলের অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে উল্লেখ করেন এমপি এস এম শাহজাদা বলেন, গুরুত্ব বিবেচনায় না নিয়ে ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে সরকারী অর্থের অপচয় হয়। অথচ উপকূলের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো পাসের অপেক্ষায় পড়ে থাকে।
সংসদ সদস্য সৈয়দা রুবিনা আক্তার বলেন, ‘কাউকে পিছনে ফেলে নয়, সকলকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে’, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা বাস্তবায়ন হলেই উপকূলের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা অনুযায়ী সংকট মোকাবেলায় সরকার ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
নদ-নদীয় শুকিয়ে যাওয়া উপকূলের জনজীবনে সংকট বেড়েছে উল্লেখ করে এমপি গে্লারিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, আমরা সংকট সমাধানে জনগণকে সাথে নিয়ে কাজ করছি। করোনা পরিস্থিতি বাঁধার সৃষ্টি করলেও আগামীতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যাবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উন্নয়ন কাজ সহজতর হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে উত্থাপিত সুপারিশে বলা হয়, সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া সারাদেশের ন্যায় উপকূলীয় এলাকায় পৌছালেও টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে তা আজ ঝুঁকির মুখে। তাই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে। জাতীয় বাজেটে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থ বাস্তবায়নে সমম্বয় করে উপকূলীয় এলাকার জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে সম্পৃক্ত করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
সুপারিশে আরো বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলকে দূর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে সেখানকার জীবন-জীবিকা ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। লবণাক্ততার আগ্রাসনের শিকার উপকূলের সুপেয় পানির সংকট নিরসন এবং মৎস্য ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সুন্দরবন ও আশপাশের ঐতিহ্যবাহি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের প্রসারের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকার প্রণীত ডেল্টাপ্লান বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সাগর তীরবর্তী এলাকা সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সুপার ড্রাইভওয়ে নির্মাণ করতে হবে। উপকূলের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অবিলম্বে হাওড় উন্নয়ন বোর্ডের ন্যায় উপকূল উন্নয়ন বোর্ড গঠন করতে হবে।