মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: টেকসই পোলট্রি শিল্পের জন্য এফসিআর উন্নত করে ফিড খরচ কমাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন এসিআই এগ্রিবিজনেস -এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এফএইচ আনসারী। পোলট্রির গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি এখন করতে হবে তা হচ্ছে- উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন। এটির মাধ্যমে শিল্পটিকে একটি টেকসই অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে; নয়তো কখনো ভালো, কখনো ফেসে যাবে।
ড. আনসারী এগ্রিনিউজ২৪.কম কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পোলট্রি একটি সংবেদনশীল শিল্প। এখানে অর্থনীতি আছে, বায়োলজি আছে, এখানে বিজ্ঞান আছে, ছোট ছোট খামারি আছে, ইন্টিগ্রেটর আছে, সরকার বা পলিসি মেকার আছে এবং এর সাথে জাতির খাদ্য সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান আছে। পোলট্রি যেহেতু সংবেদনশীল একটি শিল্প তাই এটির টেকসই উন্নয়নের জন্য আমাদের কেয়ারিফুল্লি সিস্টেমেটিক্যালী কাজ করতে হবে। একেবারেই কাজ যে হচ্ছে না তা নয়, যথেষ্ট কাজ হচ্ছে এবং বিনিয়োগও আসছে।
“অন্যান্য শিল্পের মতো পোলট্রি শিল্পেও বেশ কয়েকটি অঙ্গ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ফিড। কিন্তু ইদানিংকালে বিশ্ববাজারে ফিড তৈরির বিভিন্ন কাঁচামাল যেমন- ভুট্টা, সয়াবিন মিলসহ যাবতীয় পণ্যের দাম ও আমদানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফিডের দাম বেড়ে গেছে এবং এতে করে পোলট্রি শিল্প হুমকির মুখে চলে যাচ্ছে। কারণ, পোলট্রি উৎপাদনে মোট ব্যায়ের সিংহভাগই খরচ হয় ফিড বা মুরগির খাদ্যে। টেকসই পোলট্রি শিল্পের জন্য এফসিআর উন্নত করে ফিডের এই খরচ আমাদের কমাতে হবে এবং সেটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যুসম্মত উপায়ে” যোগ করেন ড. আনসারী।
তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাপী খাদ্য (ফিড) তৈরির মূল উপাদান বা কাঁচামাল যেহেতু আমদানি নির্ভর সেহেতু ফিডের দাম সহসা কমানো একটু কঠিনই বটে। এক্ষেত্রে আমাদেরকে এফসিআর (খাদ্য রুপান্তর হার) উন্নত করতে হবে। এই এফসিআর উন্নত করার জন্য দুটো জায়গায় সমন্বয় করতে হবে; একটি হলো- ফিড উৎপাদনকারী এবং অপরটি হলো খামারি। এ দুটো জায়গায় সমন্বয় করতে পারলে এফসিআর উন্নত করা কঠিন কোন বিষয় নয়।”
ড. আনসারী এ প্রতিবেদককে বলেন- ভারত, চীন, ভিয়েতনাম কিংবা থাইল্যান্ডে এফসিআর অনেক আগেই উন্নত করে ফেলেছে। এসব দেশগুলোতে প্রতিকেজি ব্রয়লার মাংস উৎপাদন করতে যেখানে ১.২-১.২৫ কেজি ফিডের প্রয়োজন হয়, সেখানে আমাদের দেশে গড়ে প্রয়োজন হয় ১.৫-১.৬ কেজি। আমাদের দেশে যদিও কেউ কেউ এফসিআর উন্নত করে ফেলেছে কিন্তু সেটির সংখ্যা খুবই কম। তারমানে হলো- আমাদের কেউ কেউ কম খাবার দিয়েও এক কেজি মাংস উৎপাদন করতে পারছে, আবার একই পরিমাণ মাংস উৎপাদন করতে কারো কারো বেশি খাবার লাগছে! এক্ষেত্রে যারা কম খাবার দিয়ে পোলট্রি উৎপাদন করতে পারছেন তাদের উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে; যাদের খরচ বেশি হচ্ছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই, কম খরচে স্বাস্থ্যগতভাবে কীভাবে নিরাপদ পোলট্রি উৎপাদন করে অর্থনৈতিভাবে লাভবান হওয়া যায় সেটিই এখন গুরুত্বপূর্ণ এবং এটির জন্য খামারিদের দরকার প্রশিক্ষণ।
তিনি বলেন, খামারিদের এই প্রশিক্ষণগুলো খুব ভালোভাবে দিতে হবে যাতে তারা বিজ্ঞানসম্মতভাবে পোলট্রি পালন শিখতে পারে। প্রশিক্ষণগুলোর মধ্যে থাকবে- মুরগির বাচ্চা, সুষম ফিড, পরিবেশ, ভ্যাকসিনেশন, কন্টামিনেশন, হারভেস্টিং, হাইজিন মেইনটেইন ইত্যাদি বিষয়। এগুলো সঠিকভাবে শিখাতে পারলে দাম বেশি থাকলেও ফিড সাশ্রয়ের মাধ্যমে সার্বিকভাবে উৎপাদন খরচ কম হবে এবং খামারিরা লাভবান হবেন।
এফসিআর কমাতে যেয়ে ক্ষতিকারক গ্রোথ হরমোন বা এন্টিবায়োটিকের দিকে যদি কেউ ঝুঁকে যায় এবং মাংসের মান ও স্বাদ কমে যায় সেক্ষেত্রে সেক্টরের কী লাভ হবে -এগ্রিনিউজ২৪.কম এর পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন করা হলে উত্তরে ড. আনসারী বলেন- এফসিআর কমানো বা খাদ্য খরচ কমানো মানে অস্বাস্থ্যকর বা মানহীন ফিড উৎপাদন নয়। পোল্ট্রি উৎপাদনের প্রধান খরচ যেহেতু খাদ্য; তাই এই খাদ্যটা কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত হবে এবং গুনগত মান ঠিক রাখতে হবে। কোয়ালিটির ক্ষেত্রে কিন্তু কোনোভাবেই কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। কোনো গ্রোথ হরমোন বা এন্টিবায়োটিক বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে আমরা মনে করলাম- খাদ্য খরচ কম হলো; কিন্তু খাবারের কোয়ালিটি নষ্ট হয়ে গেলো তখন লাভ হবে না। এজন্যই আমাদের দরকার পোলট্রি সম্পর্কে যথেস্ট জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ। আমি আবারো বলছি- এফসিআর উন্নত বা কমাতে হবে অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মত ও স্বাস্থ্যকর উপায়ে এবং সেটির কৌশল আমাদের জানতে ও শিখতে হবে।
পোলট্রি পণ্যের বাজার সম্পর্কে ড. আনসারী এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, দেশের অর্থনীতি যেভাবে গ্রোথ হচ্ছে এবং আমাদের প্রায় এক কোটির মতো মধ্যবিত্তের যে সংখ্যা বিশেষ করে যারা শহরে বাস করেন তারা কিন্তু এখন পোলট্রি প্রক্রিয়াজাত খাবার খাচ্ছেন এবং এটির পরিমান দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য শিল্পোদ্যাক্তাদের পোলট্রি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরনের ক্ষেত্রে মনোযোগী হবে। এই প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো যদি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে উৎপাদন করে স্বাদ ও মানে ঠিক রাখা যায় তবে ভোক্তাদের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য হবে এবং এটির বাজার বাড়তেই থাকবে।
রপ্তানি প্রসঙ্গে ড. আনসারি বলেন, শুধু দেশীয় বাজার নয়, আমাদের রপ্তানির দিকে সিরিয়াসলি এগুতো হবে এবং সেজন্য যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। আমরা যদি পোলট্রিজাত পণ্য দেশের বাইরে পাঠাতে পারি তাহলে সুবিধা হবে যে- আমাদের যখন বাড়তি উৎপাদন হয় তখন এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা সম্ভব হবে এবং খামারিরা কখনো ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত বা লোকসানের সম্মুখীন হবেন না। রপ্তানির জন্য আমাদের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পোলট্রি উৎপাদন করতে হবে। এটি করার জন্য আমাদের ট্রেস থাকতে হবে মুরগীগুলো কোন খামার থেকে আসছে, তারা কি ধরনের খাবার খাওয়াচ্ছে, তাদের ব্যবস্থাপনা কেমন, কোন ধরনের কন্টামিনেশন হচ্ছে কী না -এসব বিষয় খেয়াল করতে হবে। এছাড়াও যারা রপ্তানি করবে তাদের হাইজিনের জন্য যত ধরনের স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেশন আছে সেগুলো থাকতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে- অনেক দেশ যেমন আমাদের পণ্য নিতে চাইবে আবার অনেক দেশ নিতে চাইবে না। সেক্ষেত্রে সরকারকে বার্গেইনিং করতে হবে এবং বিদেশী সরকারের সাথে বোঝাপড়া করে আমাদের দেশের চিকেন যাতে গ্রহণযোগ্য হয় সেজন্য সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। মুসলিম দেশগুলোতে হালাল-হারাম একটি ইস্যু আছে এবং বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে হালাল পোলট্রিজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের এক্ষেত্রে হালাল পণ্য উৎপাদন করে মুসলিম দেশগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা এবং তাদের বাজার ধরা সম্ভব। এটির জন্য আমাদের সরকার কিন্তু দেশ-বিদেশে অনেক বেশি কাজ করতে পারে। আমাদের দেশে যে অ্যাম্বাসিগুলো আছে সেখানে নেগোসিয়েট করে আমাদের চিকেনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যেতে পারে। এভাবে সামগ্রিক সমন্বয়ের মাধ্যমেই আমরা পোলট্রি শিল্পকে এগিয়ে এবং একটি টেকসই অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবো। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে এবং সেটি হলো মুরগিকে সঠিক সময়ে ভ্যাকসিনেশন অবশ্যই করাতে হবে। যখন যে ভ্যাকসিন প্রয়োজন সেটি সঠিক সময় ও পরিমানমতো দিতে হবে, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবহেলা করা যাবে না।