রবিবার , নভেম্বর ১৭ ২০২৪

আমের বৌল পচা রোগের উৎস ও নিয়ন্ত্রণ

আমগাছের পাতায় অনেকসময় দেখবেন, কালো রঙের শুকনো কিছু পচা দাগ পড়েছে। এরূপ দাগ দেখলে বুঝবেন যে, সেসব পাতা এ রোগে আক্রান্ত।

মৃত্যুঞ্জয় রায় : আমের বৌল যখন বের হয়, তখন কুয়াশাও পড়ে। কুয়াশা পড়লে আমের মুকুল বা বৌল একটি ছত্রাক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মুকুল ধরা অবস্থায় বৃষ্টি হলে ও কুয়াশা বেশি পড়লে এ রোগ বাড়ে। মাটিতে পড়ে থাকা রোগাক্রান্ত পাতা, মুকুল ও গুটি আম এ রোগের প্রাথমিক উৎস। গাছে থাকা আক্রান্ত পাতা, মুকুলের ডাঁটি, পাতা ইত্যাদিও রোগের উৎস। অনুকূল পরিবেশ পেলে এসব আক্রান্ত স্থান থেকে পরের বছর মুকুল এলে সেসব মুকুল আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত পাতাই আসলে পুন:আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর্দ্রতা বেশি থাকলে এ রোগ বেশি হয়। বৃষ্টি ও শিশির এ রোগের জীবাণুর বিস্তার ঘটায়। গাছের কোথাও ক্ষত সৃষ্টি হলে সেসব ক্ষতের মাধ্যমে সহজে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে ও সংক্রমণ সৃষ্টি করে।

আমগাছের পাতায় অনেকসময় দেখবেন, কালো রঙের শুকনো কিছু পচা দাগ পড়েছে। এরূপ দাগ দেখলে বুঝবেন যে, সেসব পাতা এ রোগে আক্রান্ত। এরূপ দাগের জন্য এ রোগের নাম দেওয়া হয়েছে শুকনো পচা, শুকনো ক্ষত বা অ্যানথ্রাকনোজ রোগ। এরূপ আক্রান্ত ডাল বা পাতাই আমের বৌল পচানোর রোগের উৎস। এ রোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুকুল। আক্রান্ত মুকুল নষ্ট হয়, কালো হয়ে পচে যায় ও শুকিয়ে ঝরে পড়ে। সেসব মুকুলে কোন গুটি হয় না বা হলেও খুব কম হয়। এরূপ মুকুল থেকে যেসব গুটি হয় সেগুলোও গুটি অবস্থায় তার গায়ে ছোট ছোট কালো দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত গুটি আম ঝরে পড়ে। বড় আম আক্রান্ত  হলে দাগের স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয় ও অনেক সময় তা ফেটে যায়। এ রোগে সম্পূর্ণ আমটাই পচে যেতে পারে। তাই মুকুল আসার আগেই সাবধান না হলে গাছে প্রচুর বৌল আসার পরও সে গাছে কোনো আম না-ও ধরতে পারে। এ দেশে সব এলাকায় সব জাতের গাছেই এ রোগ হতে পারে।

রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য যা করবেন

  • এ রোগ প্রতিরোধী কোন জাত পাওয়া যায়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফজলী ও আশ্বিনা জাতের আমে এ রোগ বেশি দেখা গেছে, পক্ষান্তরে ল্যাংড়া জাতে দেখা গেছে সবচেয়ে কম।
  • এ রোগে আক্রান্ত পাতা, ডালের আগা, মুকুলদ- কেটে সরিয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত ফল, পাতা, ডাল গাছের তলায় পড়ে থাকলে সেসব কুড়িয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
  • গাছে বৌল বা মুকুল আসার পর মুকুলদ- ৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হলে অর্থাৎ আমের ফুল ফোটার আগেই প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার টিল্ট ২৫০ইসি বা ১০ গ্রাম ব্যাভিস্টিন অথবা ২০ থেকে ৩০ গ্রাম ডায়থেন এম৪৫, পেনকোজেব, ইন্ডোফিল এম৪৫ ইত্যাদি ছত্রাকনাশকের যে কোন একটি ভালভাবে মিশিয়ে মুকুলে স্প্রে করতে হবে। এমনকি গাছ থেকে আম পাড়ার পর জুন-জুলাই মাসে ডাল-পাতায় একবার স্প্রে করেও সুফল পাওয়া যায়। প্রথম বার স্প্রে করার ১৫ থেকে ২০ দিন পর গুটি মার্বেল আকারের হলে একইভাবে আর একবার স্প্রে করতে হবে। এতে কচি আমে আক্রমণ প্রতিহত হয় এবং আম ঝরে পড়া কমে। কীটনাশকের সাথে এসব ছত্রাকনাশক মিশিয়ে একত্রে স্প্রে করা যেতে পারে। অন্যান্য অনুমোদিত ছত্রাকনাশকগুলো হলো কারিশমা ২৮এসসি, ডোভার ২৮এসসি, নভেরা ২৮এসসি, এমিস্টার টপ, কয়েন ৩২.৫এসসি, নোইন ৫০ডব্লিউপি, টারবো ৫০ডব্লিউপি, অটোস্টিন ৫০ডব্লিউডিজি, চ্যাম্পিয়ন ৭৭ডব্লিউপি ইত্যাদি।
  • গাছ থেকে পরিণত আম পাড়ার পর হাতে সহ্য হয় এমন গরম পানিতে (৫১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) আমগুলো ১০ থেকে ১৫ মিনিট চুবিয়ে বাতাসে শুকিয়ে ঝুড়িতে ভরতে হবে।
  • আম বাগানে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভালভাবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করে সর্ব্বোচ্চ ফলন পাওয়া যায়। আম্রপালি জাতে এক পরীক্ষায় ছাঁটাই, আগাছা পরিষ্কার, বাগানের মাটি কোপানো, সুষম সার প্রয়োগ (প্রতি গাছে ১০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ৩৫০ গ্রাম এমওপি, ১০০ গ্রাম জিপসাম ও ১০ গ্রাম জিংক সালফেট সার), মৌসুমে ১৪ দিন পর পর সেচ প্রদান, মৌসুমে ৩ বার ডায়থেন এম৪৫ ছত্রাকনাশক স্প্রে ইত্যাদি কাজ করে অ্যানথ্রাকনোজ নিয়ন্ত্রণ করে সর্বাধিক ফল ধরানো সম্ভব হয়েছে।

(তথ্যসূত্র: মৃত্যুঞ্জয় রায়, ২০১৭, ফলের রোগ, প্রান্ত প্রকাশন, ঢাকা।)

This post has already been read 4879 times!

Check Also

জলঢাকায় সোনালী ধানের শীষে দুলছে কৃষকের স্বপ্ন

বিধান চন্দ্র রায় (নীলফামারী) : নীলফামারীর জলঢাকায় মাঠের যে দিকে চোখ যায়, সেদিকেই সবুজের সমারোহ। …