কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন : ফসল কাটার সময় শ্রমিক সংকট এখন বাংলাদেশে নিত্যবছরের সমস্যা। শিল্পায়নের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে কয়েক দশক ধরে মানুষ শহরমুখী। তাই প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি শ্রমিক। সামনে এ সংকট আরও বাড়বে। কেননা দেশ বর্তমানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে। এর একটা সমাধান হতে পারে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। কেননা আধুনিক কৃষি যন্ত্রগুলো অল্প সময়ে অনেক বেশি কাজ করে। আর এগুলো চালনার জন্য লোকও লাগে কম। যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষি পেশায় জড়িত সেই পেশার অর্থনৈতিক চিত্র পরিবর্তন করতে হলে খরচ কমাতে হবে কৃষকের। কৃষিতে যুক্ত করতে হবে প্রযুক্তির ছোঁয়া। সেই চিন্তা থেকে ‘ব্রি হোলফিড কম্বাইন হারভেস্টার’ নামের একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর ফার্ম মেশিনারী এন্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন “যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ) প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশে এই প্রথম স্থানীয় ওয়ার্কশপে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টার ডিজাইন ও তৈরী করেছেন ব্রির বিজ্ঞানীরা।
উক্ত প্রকল্পের পরিচালক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম জানান, দেড় বছর ধরে গবেষণা করে যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলকে টার্গেট করে যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়। কারণ বোরো মৌসুমে শ্রমিক সংকট এবং পাহাড়ি ঢলে প্রচুর ফসল নষ্ট হয়। তবে আমন এবং বোরো উভয় মৌসুমে যন্ত্রটি দিয়ে ধান কাটা যাবে। তবে এখনই বাজারে মিলবে না এই যন্ত্র। এ ধরনের যন্ত্র বাণিজ্যিক উৎপাদন করতে বড় ওয়ার্কশপ প্রয়োজন। এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট স্থাপনের বিষয়ে কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। শিগগিরই যন্ত্রটি বাজারজাতকরণের জন্য একটি ভালো মেশিনারি উৎপাদক কোম্পানিকে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
প্রকল্প পরিচালকের তত্ত্বাবধানে হারভেস্টারটি উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্রির সাবেক উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (এসএসও) ড. মো. আশরাফুল আলম। তিনি জানান, যন্ত্রটি উদ্ভাবনের সময় মোট ১৯টি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হয়েছে। এই যন্ত্র বা হারভেস্টারটির দাম আমদানি করা হারভেস্টারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক, কিন্তু প্রচলিত যন্ত্রের চেয়ে ধান কাটার সক্ষমতা অনেক বেশি এবং সময়ও কম লাগে।
গবেষণা টীমের অন্যতম সদস্য ফার্ম মেশিনারী এন্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ এর উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (এসএসও) ড. মো. গোলাম কিবরিয়া ভূঞা জানান, ব্রি হোলফিড কম্বাইন হারভেস্টার-এর দৈর্ঘ্য পাঁচ হাজার ২০০ মিলিমিটার, প্রস্থ এক হাজার ৮০০ মিলিমিটার এবং উচ্চতা দুই হাজার ৬০০ মিলিমিটার। ঘণ্টায় তিন থেকে চার বিঘা ধান কাটতে পারে যন্ত্রটি। এই যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা থেকে মাড়াই-ঝাড়াই পর্যন্ত করা যাবে। শুধু সময় না, বাঁচাবে কৃষকের খরচও। তিন বিঘা জমির ধান কাটতে পুরো প্রক্রিয়ায় খরচ হবে ৫০০ টাকার মতো। কম্বাইন হারভেস্টারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি কাদায়ও চলবে। এমনকি ছোট জমিতেও ব্যবহার করা যাবে। ফোর সিলিন্ডার মেশিন, তাই শব্দও অনেক কম হবে বলে দাবি গবেষকদের।
গবেষকরা জানান, কৃষকের ছোট ও কর্দমাক্ত জমি বিবেচনায় নিয়ে যন্ত্রটি তৈরী করা হয়েছে। এটি ৮৭ অশ্ব শক্তি সম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে চালিত হয়। এটি প্রতিবারে ১.৫ মিটার (কাটার প্রস্থ) জমির ধান কর্তন করতে পারে এবং স্টোরেজ ট্যাংকে ৬০০ কেজি পর্যন্ত ধান সংরক্ষণ করতে পারে। উচু-নিচু ও কাঁদা জমিতে যন্ত্রটি সহজে চালনার জন্য ৩০০ মিমি গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স রাখা হয়েছে। যন্ত্রটির মোট ওজন ৩০০০ কেজি এবং ট্রাকশন লোড ২১ কিলোনিউটন/মিটার২ হওয়ায় সহজেই কাঁদাযুক্ত জমির ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও সংরক্ষণ করতে পারে । এটি প্রতি ঘন্টায় ৩-৪ বিঘা জমির ধান কর্তন করতে পারে এবং ডিজেল খরচ হয় ৩.৫ -৪ লিটার। যন্ত্রটি ব্যবহারে হারভেস্টিং লসও খুবই কম (শতকরা ১% এর কম)। স্থানীয় ওয়ার্কশপে যন্ত্রটি তৈরী করতে ১২-১৩ লক্ষ টাকা খরচ হয়।
যন্ত্রটি তৈরীর পর লোড-আনলোড অবস্থায় ল্যাবরেটরিতে এর বিভিন্ন অংশের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। পরবর্তীতে গত ১৯ নভেম্বর, ২০২১ খ্রি. তারিখে বিএডিসি ফার্ম, চুয়াডাঙ্গায় ব্রি’র মহাপরিচালক, পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক, বিভাগীয় বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক, আমদানিকৃত কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রের চালক এবং কৃষকের উপস্থিতিতে মাঠ পরীক্ষণ সম্পন্ন করা হয়। মাঠ পরীক্ষণে উপস্থিত সকল সদস্য যন্ত্রটির কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ্য করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
প্রকল্প পরিচালকের তত্ত্বাবধানে প্রধান গবেষক হিসাবে ড. মোঃ আশরাফুল আলম এবং তাঁর টিম নিরলসভাবে চেষ্টা করে জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং এ যন্ত্রের প্রথম প্রোটোটাইপ তৈরী করা হয়। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমরা যন্ত্রটি মাঠে পরীক্ষা করে ভালো ফলাফল পেয়েছি। বাংলাদেশের খন্ডিত চাষের জমির ধান কাটতে এটি অধিক কার্যকর এবং আমদানিকৃত কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রের তুলনায় তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে”। তিনি বলেন, কম্বাইন হারভেস্টারটি দিয়ে দিনে ২০-৩০ বিঘা জমির ধান কাটা যাবে। জ্বালনি খরচও খুব কম। এক ঘণ্টায় জ্বালানি খরচ হবে চার লিটার।
মাঠ পরীক্ষণে এর কার্যকারিতা পরীক্ষার পর গবেষকরা গত ৩১ ডিসেম্বর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর ব্রি হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টার প্রত্যক্ষ করে মন্ত্রী বলেন, ব্রি’র বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী কম্বাইন হারভেস্টার উদ্ভাবন করেছে যেটির ইঞ্জিন ও ক্রলার বাদে সকল পার্টস স্থানীয় ওয়ার্কশপে তৈরী করা হয়েছে। যন্ত্রটির কার্যক্ষমতাও বেশী এবং কৃষকের ছোট জমিতেও সহজে চালনা করা যাবে। আমি মনে করি, স্থানীয় কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারীদের সক্ষমতা এবং ব্রি’র বিজ্ঞানীদের ডিজাইন ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যদি যন্ত্রটি প্রস্তুত করি তবে এটি হবে আমাদের অসাধারণ সাফল্য। সরকারি এবং বেসরকারী উদ্যেগে এ দেশে এসেম্বলী লাইন তৈরি করতে পারলে স্বল্প মূল্য যন্ত্রটি প্রস্তুত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক ড. মোঃ শাহজাহান কবীর বলেন, ব্রি’র বিজ্ঞানীরা যে কম্বাইন হারভেস্টারটি তৈরী করেছে সরকারের নীতি ও আর্থিক সহায়তা পেলে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতির অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানো সম্ভব হবে এবং বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে। তিনি বলেন, ব্রি হোল ফিড কম্বাইন হারভেষ্টারটি মুজিব শতবর্ষ, স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী এবং ব্রির সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশের কৃষকের জন্য ব্রির এক অনন্য উপহার। বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ব্রি হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টার বিপ্লব ঘটাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন ।
লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর এবং পিএইচডি ফেলো, কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, শেকৃবি, ঢাকা।