মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: দেশের খামারি থেকে শুরু করে ফিড মিলার, পোলট্রি শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেই এখন চাপের মুখে রয়েছেন, বলে মন্তব্য করেছেন দেশের প্রাণিজ শিল্প খাতের অন্যতম স্বনামধন্য কোম্পানি প্লানেট গ্রুপ -এর পরিচালক; ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন-বিবি ও ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ -এর নির্বাহী সদস্য শাহ্ ফাহাদ হাবীব। বয়সে তরুন ও উদ্যোমী উদ্যোক্তা মনে করেন, চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে গত বছরের তুলনায় চলতি সময়ে আরো বেশি চাপের মুখে পড়েছে পোলট্রি ও ফিড শিল্প। সারাবিশ্বে কাঁচামালের দাম ও জাহাজ ভাড়া অত্যাধিক বেড়ে যাওয়াতে খামারি এবং শিল্পোদ্যোক্তা সবাই এক ধরনের আতংকের মধ্যে রয়েছেন। ফিড তৈরির যাবতীয় কাঁচামাল ও পোলট্রির অধিকাংশ ওষুধ আমদানি নির্ভর হওয়াতে সমস্যাটি প্রকট হয়েছে।
মি. ফাহাদ এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, নানান উত্থান পতনের পরও ২০১৯ সন পর্যন্ত শিল্পটি একটি স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পর মানুষের মনে এক ধরনের আতংক ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল, কলেজ, হোটেল রেস্তোরা, সামাজিক অনুষ্ঠান, বিদেশীদের যাতায়াত ইত্যাদি সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ব্রয়লার মুরগির ও ডিমের দাম অনেক কমে যায়। এক কথায় বলতে গেলে, কোভিড শুরুর পর থেকেই দেশের পোলট্রি সেক্টর একটি হুমকির মধ্যে রয়েছে।
তিনি জানান, পৃথিবীব্যাপী এবং আমাদের মূল কাঁচামালগুলোর যোগানদাতা চায়না বা ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতে মহামারিটি খুব শক্তভাবে হানা দেয়াতে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমাদের চাহিদকৃত পণ্য ঠিকমতো শিপমেন্ট করতে পারেনি; যার জন্য মার্কেটে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়। ফলে ২০২০ সনের পর থেকেই ফিড তৈরির যাবতীয় উপকরণের দাম বাড়তে থাকে; যেগুলোর দাম বর্তমানে অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেছে।
“২০২১ সনের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে যে ভুট্টা আমরা ১৯-২০ টাকা কেজিতে ক্রয় করেছি সেটি ৩২ টাকায় ক্রয় করতে হয়েছে; সয়াবিনের মূল্য যেখানে ছিল ৩৬ টাকা সেটি ৪৮-৫৩ টাকা দিয়েও আমরা ক্রয় করেছি। অথচ ফিড তৈরিতে ৫০-৫৫% লাগে ভুট্টা এবং ২৫-৩০% সয়াবিনের প্রয়োজন হয়। ভুট্টার দাম যদি কেজিপ্রতি ২টাকা বেড়ে যায় তবে ফিডের উৎপাদন খরচ বাড়ে কেজিতে ১ টাকা এবং সয়াবিনের দাম যদি কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে যায় তবে ফিডের উৎপাদন খরচ আরো ১ টাকা বেড়ে যায়। সুতরাং ১৯-২০ টাকার ভুট্টা ৩২ টাকা হলে এবং ৩৬ টাকার সয়াবিনমিল ৪৮-৫৩ টাকা হলে, ফিডের উৎপাদন খরচ কত শতাংশ বেড়েছে সেটি নিশ্চয়ই আপনারা অনুমান করতে পারছেন। তাছাড়া ফিড তৈরির অন্যান্য এডিটিভস -এর দামও বেড়ে গেছে। সেই সাথে আমদানি ব্যায় বেড়ে গেছে তিন-চারগুণ। ফলে সার্বিকভাবেই ফিড উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে এবং ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। কারণ,বাধ্য হয়েই ফিডের দাম বাড়াতে হয়েছে, ফলে খামারিদেরও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং যার খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তা সাধারণকেও” যোগ করেন শাহ্ ফাহাদ হাবীব।
ফিডের দাম বাড়ানোর পরও কি আপনাদের এখন লাভ হচ্ছে না – এমন প্রশ্নের জবাবে শাহ্ ফাহাদ হাবীব বলেন, আমরা হয়তো ফিডের দাম ৩০% মতো বাড়িয়েছি কিন্তু সার্বিক উৎপাদন খরচ বেড়েছে তারচেয়েও বেশি। আমাদের জানামতে, অনেক ফিডমিলারই লাভ করতে পারছেন না। বড় বড় ফিডমিলার যাদের বাল্ক অ্যামাউন্ট -এ কাঁচামাল ক্রয় করার মতো সামর্থ্য আছে, তারা হয়তো কিছুটা অ্যাডভান্টেজ পাচ্ছে; কিন্তু ছোট ও মাঝারি ফিডমিলারদে অবস্থা আসলেই ভালো নেই। কারণ, শুধু ভুট্টা ও সয়াবিনের দামই নয়, রাইস পলিস, ডিওআরবি থেকে শুরু করে ফিড তৈরির প্রত্যেকটা উপকরণের দামই অনেক বেড়েছে।
আমাদের ফিআব (ফিড এসোসিয়েশন বাংলাদেশ) এর তথ্যমতে, ফিডমিল অপারেশন বন্ধ হওয়ার কারণে ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান সদস্যপদ নবায়ন করতে পারছেন না, বলেও জানান তিনি।
এক্ষেত্রে সংগঠন হিসেবে ফিআব (ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশ) -এর করণীয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে শাহ্ ফাহাদ হাবীব বলেন- আমার জানামতে, ফিআব ছোট-মাঝারি-বড় সবার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছে এবং পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ট্যাক্স ভ্যাট সহ শিল্প সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠাসমূহের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে; যাতে সেক্টরের প্রত্যেকটি উইং টিকে থাকে। আসলে এ মুহূর্তে চাপে আছেন সবাই।
এনিমেল হেলথ সেক্টরের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহ্ ফাহাদ হাবীব বলেন বলেন, সম্প্রতি ডলারের দাম বেড়ে গেছে, আবার আমরা যেসব প্রিন্সিপাল বা কোম্পানি থেকে ওষুধ, ফিড এডিটিভস আমদানি করে থাকি তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াতে তারাও পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সেটি হলো- পণ্য আমদানি জাহাজ ভাড়া তিন থেকে চারগুণ বেড়ে গেছে! আগে চট্টগ্রাম বন্দরে যে পণ্যটি জাহাজ ভাড়া বাবদ ১২০০ ডলারের মতো খরচ হতো; সেখানে এখন লাগছে সাড় ৪ থেকে ৫ হাজার ডলার। প্রিন্সিপাল কোম্পানি থেকে পণ্যের দাম বাড়ানোর যে নোটিশ দিয়েছে সেই দামেই আমরা আনতে বাধ্য হচ্ছি।
এছাড়াও কোম্পানিগুলো আগে যেটিতে সিএফআর -এ অফার করতো এখন করছে এফওবি তে; ফলে আমাদের বাড়তি একটি কস্ট দিতে হচ্ছে প্রত্যেকবার আমদানিতে। আগেএকটি পণ্য আমদানি করতে যেখানে ১০০ টাকা ইনভেস্ট করতে হতো, সেখানে এখন ইনভেস্ট করতে হচ্ছে ১৪০ টাকা। ফলে প্রত্যেকের পারচেজ পাওয়ার বা আমদানি ক্যাপাসিটি কমে যাচ্ছে; ফলে যেটুকু প্রয়োজন তারচেয়েও কম পরিমাণে পণ্য ক্রয় করতে পারছে। ফলে বাজারে এক ধরনে সংকট তৈরি হচ্ছে। যাদের ক্যাপাবিলিটি বেশি তারা হয়তো স্টক মেইনটেইন করতে পারছে এবং হয়তো কিছুটা লাভের মুখ দেখছেন; কিন্তু বাদবাকী সবার প্রফিট তলানিতে যেয়ে ঠেকেছে- যোগ করেন শাহ্ ফাহাদ হাবীব।
খামারিদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশের খামারিরা সবসময়ই চ্যালেঞ্জের মুখে আছেন। কোভিড হানা দেয়ার পর খামারিরা সবচে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন; কারণ ওই সময় তারা মুরগি বিক্রি করতে পারছিলেন না এবং কঠিন সময় পার করেছেন। যাইহোক এতকিছুর পরও ২০২১ সনের অক্টোবর মাস স্বাভাবিক জীবন যাত্রা শুরু হওয়াতে মুরগি ও ডিমের দাম বেড়ে যাওয়াতে তারা গত তিন চারমাস ধরে কিছুটা স্বস্তির মধ্যে আছেন। কিন্তু করোনার নতুন রুপ অমিক্রণ শুরু হয়ে যাওয়াতে যদি আবারো ক লকডাউনের মতো কোন সিদ্ধান্ত আসে, খামারি ভাইয়েরা আবারো ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
“আমার মতে, পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সরকার চেষ্টা করছেন, আমরাও চেষ্টা করছি, বিপিআইসিসি থেকে সরকারের সব মহলের সাথে যোগাযোগ করছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি ; আমাদেরকে যদি সরকার ট্যাক্স বেনিফিট দেয় তবে আমরা আমাদের কস্টিংগুলো কিছুটা কমাতে পারি এবং তবে আমরা আরো কম মূল্যে ভোক্তা সাধারণকে ডিম ও মুরগি সরবরাহ করতে পারবো” – সরকারের করণীয় প্রশ্নে এসব কথা যোগ করেন মি. ফাহাদ।
উল্লেখ্য, উদ্ভাবনমূলক ও সময়ের চাহিদানুযায়ী বাজারে সেরা মানের পণ্য সরবরাহ করার উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১০ সনে যাত্রা শুরু করা প্লানেট গ্রুপ। কোম্পানিটির পণ্যগুলোর মধ্যো প্রাণী স্বাস্থ্য পুষ্টি পণ্য, ফিড এডিটিভস; পোলট্রি, মৎস্য ও ক্যাটল ফিড, একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা (ব্রয়লার ও লেয়ার) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্লানেট গ্রুপের সিস্টার কনসার্নগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্লানেট এগ্রো লিমিটেড, প্লানেট ফিডস লিমিটেড, প্লানেট ফার্মা লিমিটেড ও প্লানেট হ্যাচারি লিমিটেড।