ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : বেদখল হয়ে পড়ছে খুলনার সিংহভাগ সরকারি খাল ও জলাশয়। খুলনা শহরকে ঘিরে রাখা খাল ও জলাশয় বালু ভরাট করে দখলে নিচ্ছে আশপাশের জমির মালিকরা। আর শহর বা শহরতলীতে টাগের্ট করে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। এই অ-পরিকল্পিত প্রভাবশালী আবাসন ব্যাবসায়ীরা নগরীর অধিকাংশ খাল ভরাট করার ফলে এখন আর খালের অস্তত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা । এছাড়া বড় খাল ইজারা নিয়ে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত করে মাছ চাষ করছেন প্রভাবশালীরা। বাকী খালগুলো ময়লা-আবর্জনা ও দূষণে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। ফলে যুগের পর যুগ এভাবে ক্ষমতাবানদের পেটে ঢুকে অস্তিত্ব হারাচ্ছে অনেক খাল। কিছু খাল সরু হয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশনের পথ। নষ্ট হচ্ছে পানির আধারও। যা প্রকৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর ভবিষ্যতে পরিবেশে ডেকে আনছে চরম বিপর্যয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ৯ উপজেলা ডুমুরিয়া, কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রূপসা, দিঘলিয়া, ফুলতলা ও তেরখাদায় মোট ৩৮৯টি সরকারি খাল রয়েছে। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় রয়েছে ২৬২টি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায় ১২৭টি খাল রয়েছে।
বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, খালের বেশির ভাগ ময়লা-আবর্জনায় দূষণে ছোট ও সরু হয়ে গেছে। অনেক খাল ভরাট করে হাট-বাজার স্থাপন ও ভবনসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু খালে সরকারি- বেসরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। চলাচলের রাস্তা বানিয়ে অনেক খাল চিরতরে বন্ধ করা হয়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বড় বড় খাল ইজারা নিয়ে নেট-পাটা বা বাঁধ দিয়ে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত করে মৎস্য চাষ করছেন। এছাড়া শহর ও আশপাশে মরা ও আধা-মরা খালকে টার্গেট করে আবাসন ব্যবসা গড়ে তোলার হিড়িক পড়েছে।
ডুমুরিয়ার গুটুদিয়ার বাসিন্দা রেজাউল করিম জানান, ব্রিটিশ শাসনামলে পরিচালিত সরকারি জরিপের (সি এস) ম্যাপে গুটুদিয়া মৌজায় লেবুনার খাল ছিল। কৈয়া বাজারের সন্নিকটে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে অবস্থিত কালভার্ট এখনও তার সাক্ষ্য বহন করছে। অথচ দেশের সর্বশেষ জরিপের (বিএস) ম্যাপে সেই খাল ব্যক্তি মালিকায় চলে গেছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
রাজবাঁধের বাসিন্দা আব্দুস সালাম ও মোস্তফা মোড়ের বাসিন্দা কারিমুল হোসেন জানান, কৈয়া-মোস্তফার মোড় রোডের রাজবাঁধে খালের মুখ বন্ধ করে আবাসন ব্যবসা গড়ে তুলেছে বিশ্বাষ প্রোপার্টিজ। এছাড়া নতুন রেল লাইনের পাশ দিয়ে বহমান খালটি রওশন প্রোপার্টিজ দখল করে সরু করে ফেলেছে। নজরুল নগর,বাশার প্রপাট্রিজ নামক আবাসন প্রকল্পের সামনের খালও অনুরূপ দখলে ছোট হয়ে গেছে। এতে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনে পথ সংকুচিত ও বন্ধ হচ্ছে।
ডুমুরিয়া উপজেলার বাসিন্দা শাহাজান ফকির জানান, বামুন্দিয়া বিলের বাওড়ের খাল প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা ইজারা নিয়ে ঘের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কিন্তু তারা ইজারার চুক্তিপত্র ভেঙে খালে ভেড়িবাঁধ, পাটা ও নেট দিয়ে পানির স্রোত বন্ধ করছে। অনেকে সময় সাব-লীজও দিচ্ছেন। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানির সুষ্ঠু নিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হয়ে জলমহলের আশেপাশের বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ক্ষতির মুখে পড়ে ফসলী জমি ও ছোট ছোট মৎস্য ঘের।
এ ব্যাপারে বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, কোনভাবেই খালের শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কারণ খাল না থাকলে পানি নিষ্কাশনের পথ নষ্ট হয়ে জলবদ্ধতা তৈরি হবে, মশা জন্ম নেবে এবং কার্বন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে তাপমাত্রা বাড়বে। অনেক কৃষক ফসলে ফলাতে পানি পাবে না। এছাড়া মাছ শিকার করে যারা জীবীকা নির্বাহ করে তারা অসুবিধায় পড়বে।
খুলনা রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নয়ন কুমার রাজবংশী বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড খাল দেখাশোনা করে। কোন খাল খনন বা ব্যবহারে তারা জেলা প্রশাসন থেকে অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করে। এছাড়া ২০ একরের নিচে জলমহল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ২০ একরের নিচে জলমহল তার দপ্তর ইজারা প্রদান করে।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, পানি নিষ্কাশনের পথ সচল ও ফসলী জমিতে পানির উৎস হিসেবে ব্লু গোল্ডের আওতায় ১৫৪টি খাল খনন করা হয়েছে। এছাড়া ৭৪টি খাল খননের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে কী পরিমাণ খাল অস্তিত্ব হারিয়েছে বা বেদখল আছে তার কোন পরিসংখ্যান তার দপ্তরে নেই।
এ ব্যাপারে খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, মাছ চাষে আগ্রহী ও চাষের উপযোগী রাখতে প্রকল্পের আওতায় মৎস্য বিভাগ প্রতিবছর কিছু খাল খনন করে।