মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: চলমান অস্থিরতা ও বিপর্যের মধ্যে আরো বিপর্যের আশংকা দেখা দিয়েছে দেশেরে প্রাণিজ খাতের অন্যতম যোগানদাতা ফিড শিল্পে। সেই সাথে বিপর্যয়ে পড়বে দেশের পোলট্রি, মৎস্য খাত। কারণ, পোলট্রি ও মৎস্য ফিড তৈরির অন্যতম উপকরণ সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধ থাকার পর আবারো রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর হতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি (রবিবার) এ সংক্রান্ত একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
উপ নিয়ন্ত্রক নোহাম্মাদ মাহমুদুল হক স্বাক্ষরিত উক্ত গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পত্র স্মারক নং-২৬.০০.০০০-১০০-৯৯,০০১.১৭:৩৫৬, তারিখ: ১২ অক্টোবর ২০২১ এর মাধ্যমে প্রদত্ত ‘সয়াবিন মিল’ রপ্তানি বন্ধের আদেশ প্রত্যাহারপূর্বক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পত্র স্মারক নম্বর: ২৬.০০.০০০০.১০০-৯৯.০০১.২১.২, তারিখ: ০৩ ফেবুয়ারি ২০২২ এর নির্দেশনার আলোকে সয়াবিন মিল এর চাহিদা ও সরবরাহ বিবেচনায় সয়াবিন মিল এর রপ্তানি কেস-টু-কেস ভিত্তিতে উন্মুক্তকরণ করা হলো। সয়াবিন মিল এর রপ্তানি শুধুমাত্র কেস-টু.কেস ভিত্তিতে অনুমতি প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজা হবে।
আর, এই গণবিজ্ঞপ্তির ফলে ঘর্মাক্ত কপালে নতুন করে চিন্তার ভাজ পড়েছে সেক্টর সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা থেকে শুরু করে খামারি সকলের। তারা মনে করছেন, দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রধানতম যোগানদাতা পোলট্রি, মৎস্য ও ডেইরি শিল্পে আসলে কোন অভিভাবক নেই। কেউ কেউ বিষয়টিকে দেখছেন দেশীয় শিল্প ধ্বংসের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হিসেবে। ক্ষোভ প্রকাশ করে কেউ আবার বলছেন, এদেশের মানুষের স্বার্থ দেখার কি কেউ নেই? বুকের উপর স্টীম রোলার চালানো হচ্ছে – কেউ আবার অনুভব করছেন তেমনটা। নতুন করে মুরগির বাচ্চা শেডে উঠাবেন কি উঠাবেন না এমন দুঃশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে খামারিদের মনে। কারণ, গেলো কয়েক মাস ফিডের দাম বেড়ে যাওয়াতে এমনিতেই তারা আছেন বিপাকে। মাঝখানে কিছুদিন ব্রয়লার মুরগির দাম একটু বাড়লেও বর্তমানে আবার কমতির দিকে। এমতাবস্থায় সয়াবিন মিল রপ্তানির ফলে যদি ফিডের দাম আবার বেড়ে যায়, পথে বসা ছাড়া তাদের উপায় থাকবে না -এমনটা মন্তব্য করেছেন অনেক খামারি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফিআব) সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান হতাশার সুরে বলেন, আমরা বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের কথা রাখছেন না। সয়াবিন মিল রপ্তানির অনুমতি দেয়ার ফলে ফিড তথা পোলট্রি ও মৎস্য শিল্পে আরো বিপর্যয় নেমে আসবে।
তিনি বলেন, সাধারণত দুটো জিনিসের (সয়াবিন তেল ও সয়ামিল) দাম একসাথে বাড়ার রেকর্ড আগে কখনো ছিল না। এই প্রথম সয়াবিন তেল ও সয়ামিলের দাম প্রায় একসাথে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগেও যে সয়ামিলের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৪৮ টাকা, সেটির দাম এখন ৫৬ টাকা! খুব স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন খরচের সাথে সমন্বয় করতে গেলে ফিডের দাম বাড়াতে বাধ্য হতে হবে।
এজি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ -এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. লুৎফর রহমান বলেন, পোলট্রি শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র না থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। আমরা চরমভাবে হতাশ ও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। এভাবে একটি শিল্প চলতে পারে না। মাত্র সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে সয়ামিলের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৮ টাকা। অন্যদিকে ফিড তৈরি প্রধানতম উপাদান ভুট্টার দাম এখন কেজিপ্রতি ৩২ টাকা, যেটির দাম ছিল ২১-২১ টাকা। পোলট্রি ও মৎস্য খাদ্য তৈরির সিংহভাগ খরচই হয় এ দুটো উপাদান ক্রয়ে। গেলো কয়েক মাসে ফিডের দাম সমন্বয়ের চেষ্টার পরেও আমাদের যেখানে লোকসান গুনতে হচ্ছে, সেখানে সয়ামিল রপ্তানির অনুমতি ফিড পোলট্রি ও মৎস্য শিল্পকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিবে। সেক্টরটিকে এখনই দুর্যোগময় সেক্টর ঘোষণার দাবী জানান এ সময় তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের বাধ্য হয়ে এখন ফিডের দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু আমাদের খামারিদেরকেওতো বাঁচাতে হবে। গেলো এক যুগে দেশের প্রতিটা পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে কিন্তু বাড়েনি মুরগি ও ডিমের দাম। অসংখ্য খামারি ইতিমধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেছে, অনেকেই খামার বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই, অথচ পাশের দেশ ভারতে ডিম ও মুরগির দাম নির্ধারনে মনিটরিং টিম কাজ করে।
এ থেকে উত্তরণের উপায় কি জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের সবকিছু ভুলে একই কাতারে আসতে হবে। খামারি-শিল্পোদ্যোক্তা-সরকার বসে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ডিম ও মাংসের দাম নির্ধারণ করতে হবে যাতে ভোক্তা ও উৎপাদক কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন। এজন্য আমাদের সবাইকে একটি জায়গায় আসতে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে।