কৃষিবিদ ড. মো. তাসদিকুর রহমান সনেট : কৃষিই বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির প্রাণ। অনাদিকাল থেকে এদেশের মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা পূরণেরজন্য কৃষির ওপর নির্ভর করে আসছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে স্বাধীনতাত্তোরকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কৃষি শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ ও কৃষির উপকরণ বিতরণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ-পুনর্গঠনে কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জাতির পিতার প্রদর্শিত পথেই কৃষির সার্বিক উন্নয়নে নানামূখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার)। ফলশ্রুতিতে আমরা এখন দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পাশাপাশি শাক-সবজি ও দেশীয় ফল-মূলের ব্যাপক উৎপাদন জাতীয় পর্যায়ে দৈনন্দিন পুষ্টিচাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কৃষক ও কৃষিবিদগণের অসামান্য অবদানের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশে^ ধান উৎপাদনে ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু উৎপাদন ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম, চা উৎপাদনে ৪র্থ, পাট উৎপাদনে ২য়, আভান্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে ৩য় এবং ইলিশ উৎপাদনে ১ম স্থানে অবস্থান করে বিশ্বপরিমন্ডলে সমাদৃত। এই সবকিছু অর্জন সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কৃষিবান্ধব নীতির কারণে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলে বর্তমানে বিশ্বে দানাদার শস্য উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিকটন। বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিকটন। কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদগণের নিরলস প্রচেষ্টায় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কৃষিবাবান্ধব নীতির কারণে আমরা আজ কৃষিতে সমৃদ্ধ। কৃষির এই অভাবনীয় সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত নার্সভূক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ফসলের ৬৩১টি উচ্চফলনশীল নূতন জাত এবং ৯৪০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে অদ্যাবধি ব্রি কর্তৃক ধানের ৫৬টি জাত, বিএআরআই কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের ২৬০টি জাত, বিজেআরআই কর্তৃক পাটের ১৫টি জাত, বিএসআরআই কর্তৃক ইক্ষুর ৯টি জাত ও সুগারবিট, তাল ও স্টেভিয়ার ৪টি জাত, সিডিবি কর্তৃক তুলার ১০টি জাত এবং বিআইএনএ কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের ৬৮টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। জিএমও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং বিটি তুলার জাত উদ্ভাবনের কাজ চলমান রয়েছে। দেশি ও তোষা পাটের জীবন রহস্য আবিষ্কারসহ পাঁচ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচন করা হয়েছে। পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের ৫৪টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও উন্মুক্ত করা হয়েছে, এর ফলে কৃষি উৎপাদন পোঁছেছে এক অভাবনীয় উচ্চতায়।
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সোনালী ফসলে ভরপুর দেখতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে কারণেই স্বাধীনতার পর তিনি ডাক দিয়েছেন সবুজ বিপ্লবের, কৃষিকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব। বঙ্গবন্ধু বলতেন “কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে” তিনি উপলদ্ধি করতেন কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পারলে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নের ভিত্তি টেকসই হবে। তাই তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, সংস্কার-পুন:সংস্কার, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ঈক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ কৃষির অনেক নূতন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন এবং পুরনো প্রতিষ্ঠান গুলোকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তি চর্চায় শিক্ষিত যুবকদের উদ্ভুদ্ধ করেছিলেন।
১৩ই ফেব্রুয়ারি কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ার জন্য কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। সে সময়ে কৃষিবিদ নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলে বঙ্গবন্ধু বললেন “তোরা ইঞ্জিনিয়ারদের সমান চাস কেন? তোরা বেশী চাবি। আমার কাছে তো ফাইল সইয়ের জন্য আসবেই। কেউ না দিলে আমি তো তোদের দিবো।” সে সময়ের বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট (বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) এর এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নেতৃবৃন্দ ও সিনিয়র কৃষিবিদ জাতির পিতার কাছে এই দাবী জানালে তিনি সে মর্যাদা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান সরকার নতুন পে-কমিশন বানালেন এবং সে পে-কমিশনে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অবনমন করে। পূনরায় কৃষিবিদরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। সিনিয়র কৃষিবিদ ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের দাবীর মুখে জিয়াউর রহমান বাধ্য হয়ে ১৯৭৮ এর মে মাসে সে দাবী মেনে নেয় এবং ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন বঙ্গবন্ধু’র দেয়া কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিবান্ধব নীতির কারণে দেশে বর্তমানে সাতটি সরকারি এবং দুটি বেসরকারি কৃষি বিশ্বিবদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিষয়ে পাশকৃত কৃষিবিদরা দেশ গঠনে গুরুত্ত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এক সময়ে মেয়েরা কৃষি শিক্ষায় কম আসতো কিন্তু বর্তমানে কৃষির অগ্রগতির কারণে অধিক সংখ্যক মেয়েরা কৃষি শিক্ষায় এগিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত গ্রাজ্যুয়েটের সংখ্যা প্রায় ৪৫,০০০ হাজার, তাদের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে প্রায় ১৫,০০০ কৃষিবিদ এবং বেসরকারি পর্যায়ে ৫০০০ কৃষিবিদ কর্মরত। তাছাড়া সহস্রাধিক কৃষিবিদ অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে সুনামের সাথে কর্মরত রয়েছেন। সরকারি পর্যায়ে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মিলে বর্তমানে প্রায় ২৪টি কৃষিভিত্তিক সংস্থার পাশাপাশি কৃষিবিদরা ৭টি কৃষি বিশ্বিদ্যালয়, ব্যাংক বীমাসহ পুলিশ ও প্রশাসনে কর্মরত রয়েছেন। যে পেশায় থাকুক না কেন সর্বক্ষেত্রে সাফল্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। রাজনীতিতেও রয়েছে কৃষিবিদগণের আধিপত্য। বর্তমানে সরকারের দুইজন প্রভাবশালী মন্ত্রী কৃষিবিদ। এছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কৃষকলীগের সভাপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী, প্রধানমন্ত্রীর সচিব, প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার ও ব্যক্তিগত সহকারী হিসাবেও কৃষিবিদগণ কাজ করছেন। বর্তমান সরকারের ৭ জন সচিব রয়েছেন কৃষিবিদ।
কৃষিবিদদের এই মর্যাদাপ্রাপ্তির দীর্ঘকাল পরে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের ২৭ নভেম্বর ২০১০ তারিখের সভায় ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি “কৃষিবিদ দিবস” হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। এই সিদ্ধান্তের আলোকে ২০১২ সাল থেকে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ ১৩ই ফেব্রুয়ারি দিনটি কৃষিবিদ দিবস হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করে আসছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন এই যে, দিনটিকে কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের জন্য জাতীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য। আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় নিজেদের উৎসর্গ করা।
লেখক পরিচিতি: সাধারণ সম্পাদক, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, ঢাকা মেট্রোপলিটন।