বিশেষ সংবাদদাতা: ২০১০ সালে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন প্রণয়ন করে সরকার। সেখানে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মোড়কে পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। পরে ২০১৩ সালে ওই আইনের ধারা-২২ অনুযায়ী পণ্যে “পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা” প্রণয়ন করে সরকার। এতে নির্ধারিত তফসিল সংশোধন করে পোল্ট্রি ও ফিস ফিড মোড়কজাতকরণে, পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশনা যুক্ত করা হয়। এরপর থেকে পোল্ট্রি ও ফিস ফিডে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে, ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা শুরু করে সরকার। জরিমানা করা হয়, ফিড উৎপাদনকারী কারখানাগুলোকে।
দেশের পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস গ্রুপের পুষ্টি ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জানান, “বর্তমানে প্রচলিত প্রতিটি পিপি ওভেন ব্যাগ কিনতে খরচ হয় ৩৬ টাকা। আর পাটের ব্যাগ ব্যবহার করলে, এতে প্রতিটির জন্য খরচ বেড়ে দাঁড়াবে ১১৮ টাকায়। অর্থাৎ ব্যাগের দাম প্রায় ৩ গুণ বেশি। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে প্রান্তিক খামারীদের উপর। আর্থিকভাবে লোকসানে পড়বেন তারা। ফলে ভোক্তাদেরও বেশি দামে কিনতে হবে মুরগী, ডিম এবং মাছ। মুরগীর উৎপাদন খরচ প্রতি কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।”
এদিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসেন জানান, “পোল্ট্রি ফিডে ভূট্টা, সয়াবিন, লবণ এবং তেল জাতীয় উপাদান থাকায়– এটি বাতাসের সংস্পর্শে আসলে তা থেকে আর্দ্রতা গ্রহণ করবে। ফলে পোল্ট্রির খাবারে ফাঙ্গাস জন্ম নিবে। যা থেকে মাইকোটক্সিন বা বিষ হতে পারে। পাটের বস্তায় মোড়কজাত এই খাদ্য মাছ ও মুরগী খাবার হিসেবে গ্রহন করলে ওজন বৃদ্ধি অস্বাভাবিক হারে কমে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে মারাও যেতে পারে।”
এ প্রসঙ্গে পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ আখতারুজ্জামান জানান, “পোল্ট্রি ফিড ও ফিস ফিডের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ। যা ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে রাখতে হয়। একইসঙ্গে এই খাবার ৬০ দিন পর্যন্ত দোকান এবং খামারে মজুদ করা হয়। তিনি বলেন, এক পরীক্ষায় দেখা গেছে– সাধারণ পাটের ব্যাগ ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পোল্ট্রি ও ফিস ফিড নষ্ট হয়ে যায়। ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য, সাধারণ পাটের ব্যাগ ব্যবহার করা অসম্ভব বলে মনে করেন আখতারুজ্জামান।”
পোল্ট্রি শিল্প দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভবনাময় একটি খাত। ক্রমশ বেড়ে চলা এই শিল্পে বর্তমানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যা জিডিপিতে সরাসরি অবদান রাখছে, শতকরা ১ দশমিক ৪৪ ভাগ। অন্যদিকে কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য বলছে, পাটের অবদান জিডিপিতে শতকরা শূন্য দশমিক ২৬ ভাগ। অর্থাৎ, পাটের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পোল্ট্রি ও ফিস ফিডে পাটের বস্তার ব্যবহার আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত পোল্ট্রি শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।
এ প্রসঙ্গে কাজী ফার্মস গ্রুপের পুষ্টি ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে প্রচলিত প্রতিটি পিপি ওভেন ব্যাগের চেয়ে পাটের বস্তার দাম ৮২ টাকা বেশি। ফলে পাটের বস্তা ব্যবহার করা হলে বার্ষিক চাহিদা অনুযায়ী ৩০ কোটি বস্তার দাম পড়বে, প্রতিবছর
অতিরিক্ত ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। যদি পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে অতিরিক্ত এই টাকা স্বাভাবিকভাবেই খামারিকে বহন করতে হবে। যা পরোক্ষভাবে মুরগী, ডিম এবং মাছ বেশি দামে কিনতে হবে ভোক্তাদের।
ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশ- ফিয়াবের সাধারণ সম্পাদক আহসানুজ্জামান জানিয়েছেন, দেশে বছরে গড়ে প্রায় ৩০ কোটি ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হলে, এই মুহূর্তে এই বিশাল সংখ্যক পাটের ব্যাগ যোগান দেয়ার সক্ষমতা বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোর নেই।
পোল্ট্রি খাতকে এগিয়ে নিতে হলে এ খাতের ব্যয় না বাড়িয়ে– বরং প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে মোড়কজাত সমস্যার সমাধানে গবেষণা বাড়ানোর পরামর্শ দেন পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বর্তমানে পিপি ওভেন ব্যাগের সমান খরচে বিকল্প ব্যাগ উদ্ভাবন করা যেতে পারে। যাতে ফিডের গুনাগুণ নষ্ট না হয়।
তাই চলমান বাস্তবতায় পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের মোড়কে, পাটের ব্যাগ বাধ্যতামূলক ব্যবহারের নির্দেশনা পূনর্বিবেচনার বিকল্প নাই।