নিজস্ব প্রতিবেদক: গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে জানুয়ারী ২০২২ মাসে ১১টি জেব্রা মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লিখিত মতামত অনুযায়ী দায়ীদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ফৌজদারী মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। একই সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভাগীয় মামলাও দায়ের করা হবে। এছাড়াও, তদন্ত কমিটির সুপারিশকৃত ২৪ টি সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিনের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপ-মন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সচিব মোঃ মোস্তফা কামাল, অতিরিক্ত সচিব(প্রশাসন) ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন, অতিরিক্ত সচিব(জলবায়ু পরিবর্তন) মোঃ মিজানুল হক চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব(উন্নয়ন) ও তদন্ত কমিটির আহবায়ক সঞ্জয় কুমার ভৌমিক, অতিরিক্ত সচিব(পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ) কেয়া খান এবং উপসচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
তদন্ত কমিটি প্রদন্ত মন্তব্য/মতামত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঘাসে অতিরিক্ত নাইট্রেটের প্রভাব ও মিশ্র ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে (Hazardous effects of Nitrate associated with mixed bacterial infections) সকল জেব্রার মৃত্যু ঘটেছে মর্মে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
তবে, প্রথম দিকের তিনটি জেব্রার (০২-০১-২০২২ ও ০৩-০১-২০২২) মৃত্যু ধামাচাপা দেওয়া এবং আঘাতজনিত কারণ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে উক্ত মৃত তিনটি জেব্রার পেট ধারালো কিছু দ্বারা কাটা হয়েছে মর্মে কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়েছে। কে বা কারা উক্ত মৃত তিনটি জেব্রার পেট কেটেছে তা উদঘাটন করার জন্য নিবিড় তদন্তের প্রয়োজন মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, কর্তব্যরত ভেটেরিনারি অফিসারের চাহিদা মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সাফারি পার্ক মেডিক্যাল বোর্ডের সভা আহবান করবেন মর্মে বিধান থাকা সত্ত্বেও এতগুলো জেব্রার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরও জরুরিভিত্তিতে মেডিক্যাল বোর্ডের সভা আহ্বান করা হয়নি। যা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার শামিল। কোন প্রাণীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় জিডি করার প্রচলন থাকলেও এক্ষেত্রে থানায় কোন জিডি করা হয়নি, যা রহস্যজনক।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব গত ২২ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে সাফারি পার্ক পরিদর্শন করেন। উক্ত তারিখ পর্যন্ত ৮টি জেব্রা মারা গেলেও প্রকল্প পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি কর্মকর্তা বা কর্মরত অন্য কেউ জেব্রার মৃত্যুর ঘটনাটি সচিবকে অবহিত করেননি। এতে প্রতীয়মান হয় প্রথম থেকেই জেব্রা মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক, অগ্রহণযোগ্য ও সরকারি কর্মচারী আচরণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, যা দায়িত্ব অবহেলার শামিল। তদন্ত কমিটির এসকল মতামত বিবেচনায় নিয়ে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিতপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ফৌজদারী মামলা ও বিভাগীয় মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে মন্ত্রণালয়।
এছাড়াও, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক, গাজীপুরের প্রাণী মৃত্যুরোধ ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য করণীয় বিষয়ে তদন্ত কমিটির সুপারিশকৃত ১১ টি স্বল্পমেয়াদী, ৪ টি মধ্য-মেয়াদী এবং ৯ টি দীর্ঘ মেয়াদি সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, জেব্রা মৃত্যুর ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন, দায়-দায়িত্ব নিরূপণ ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সুপারিশ প্রদানের জন্য পরিবেশ, বন পরিবর্তন জলবায়ু মন্ত্রণালয় ২৬ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ৩০ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে পরবর্তীতে কমিটিতে আরও দুজন বিশেষজ্ঞ সদস্য এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে জেলা প্রশাসক, গাজীপুরের প্রতিনিধি হিসেবে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে কো-অপ্ট করা হয়। তাছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটিকে কাজের সহায়তা এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের জন্য ৩ (তিন) জন কর্মকর্তাকে মনোনয়ন প্রদান করা হয়। ০৮ (আট) সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি এবং ৩(তিন) সদস্য বিশিষ্ট সহায়ক প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ও ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে সরেজমিন তদন্তপূর্বক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
সর্বশেষ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে কমিটির সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, তদন্ত কমিটির আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের মেয়াদ ১০/২/২০২২ তারিখ হতে আরও ৭(সাত) কার্যদিবস বৃদ্ধি করা হয়। তদন্তের স্বার্থে কমিটি, ১। প্যাথলজি বিভাগ ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), ময়মনসিংহ। ২। কেন্দ্রীয় রোগ অনুসন্ধান গবেষনাগার (সিডিআইএল), ৪৮-কাজী আলাউদ্দিন রোড, ঢাকা।, ৩। Quality Control (QC) Lab, প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর, সাভার, ঢাকা।, ৪। রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনিষ্টিউিট(আইইডিসিআর), মহাখালী, ঢাকা-১২১২।, ৫। কেমিক্যাল ল্যাব, বাংলাদেশ পুলিশ, সিআইডি, ঢাকা। এবং ৬। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (SRDI), খামার বাড়ী সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকায় রাসায়নিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে। সার্বিক তদন্ত শেষে ২০ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।