সোমবার , নভেম্বর ১৮ ২০২৪

বারি কলা-১ এর চাষ পদ্ধতি ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা

উচ্চ ফলনশীল এ জাতটি ২০০০ সালে উদ্ভাবিত হয়। গাছ অমৃতসাগর জাতের গাছের চেয়ে খাঁট, অথচ ফলন দেড় থেকে দুই গুন বেশী। প্রতি কাঁদির ওজন প্রায় ২৫ কেজি, কাঁদিত ৮-১১ টি ফানা থাকে। উপযুুক্ত পরিচর্যা পেলে এ জাতের কাঁদিতে ১৫০-২০০টি কলা পাওয়া যায়।

উপযোগী এলাকা  : দেশের সর্বত্র্ চাষ উপযোগী

বপনের সময়  : বছরের যে কোন সময়েই কলার চারা রোপণ করা যায়। তবে অতিরিক্ত বর্ষা ও অতিরিক্ত শীতের সময় চারা না লাগানোই উত্তম। বর্ষার শেষে আশ্বিন-কার্তিক মাস চারা রোপণের সর্বোত্তম সময়। এ

মাড়াইয়ের সময়:  ঋতু ভেদে রোপণের ১০-১৩ মাসের মধোই সাধারণত সব জাতের কলাই পরিপক্ক হয়ে থাকে।

ফলন: ৫০-৬০ টন/হেক্টর

রোগবালাই দমন ব্যবস্থা

রোগবালাই:

পানামাঃ পানামা কলার সবচেয়ে ক্ষতিকারক রোগ। সবরি কলার জাত এ রোগের প্রতি খুব বেশী সংবেদনশীল। এটা ফিউজেরিয়াম নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে এবং ছত্রাক মাটিতেই থাকে । প্রথমে আক্রান্ত গাছের নিচের পাতাগুলির কিনারা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। তারপর আস্তে আস্তে মধ্যশিরার দিকে অগ্রসর হয় এবং গাঢ় বাদামী রং ধারণ করে। পরবর্তীতে উপরের পাতাগুলো হলুদ হতে শুরু করে। ব্যাপকভাবে আক্রান্ত পত্রফলক পত্রবৃমত ভেঙ্গে ঝুলে পড়ে। ফলে ভুয়াকান্ডটি শুধু স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক সময় ভুয়াকান্ডের গোড়া লম্বালম্বিভাবে ফেটে যায়। ভুয়াকান্ড এবং শিকড় আড়াআড়িভাবে কাটলে খাদ্য সঞ্চালন নালীর মধ্যে লালচে-কালো রং এর দাগ দেখা যায়।

সিগাটোকাঃ এ রোগের প্রথম লক্ষণ হ’ল গাছের তৃতীয় অথবা চতুর্থ কচি পাতায় ছোট ছোট হলুদ দাগ পড়া। তারপর দাগগুলো আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায় এবং বাদামী রং ধারণ করে। ব্যাপকভাবে আক্রান্ত পাতাকে পোড়া মনে হয়। এ রোগে আক্রান্ত গাছের ফলন ১০-১৫% কম হয়।

হার্ট রটঃ এটি একটি ব্যাক্টেরিয়া জনিত রোগ। এ রোগের লক্ষণ হ’ল গাছের শীর্ষ পাতা কাল হয়ে পচে যায়।

বানচি টপ বা গুচছ মাথা রোগঃ এটি ভাইরাসজনিত রোগ।আক্রান্ত গাছের পাতা সরু, খাটো ও উপরের দিকে খাড়া থাকে। কচি পাতার কিনারা উপরের দিকে বাকানো ও সমতল হলুদ রংয়ের হয়। একটি পাতা বের হয়ে বৃদ্ধি পাবার আগেই আর একটি পাতা বের হয় কিন্তু পত্রবৃন্ত যথাযথভাবে বৃদ্ধি পায় না। এমনিভাবে অনেকগুলো পাতা গুচছাকারে দেখায়। গাছ ছোট অবস্থায় আক্রান্ত হলে মোচা কখনও হয় আবার কখনও হয় না। ফুল আসার আগে আক্রান্ত হলে গাছে মোচা বের হলেও স্বাভাবিক ফল হয় না। জাব পোকার মাধ্যমে এরোগ ছড়ায়।

কৃমি রোগ বা নেমাটোডঃ নেমাটোড কলার একটি মারাত্বক রোগ। বিভিন্ন প্রজাতির কৃমি কলা গাছের শিকড় ও গোড়ায় দু’ভাবে ক্ষতি করে থাকে। প্রথমত কৃমি আক্রান্ত শিকড়ে অতি সহজে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে। শিকড়টি অতি সহজেই কালো হয়ে পচে যায়। ফলে মাটি হতে গাছ আর খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। গাছ দুর্বল ও অপুষ্টিতে ভোগে। কলার ফলনও ব্যাপক ভাবে কমে যায়। দ্বিতীয়ত শিকড়ের মাটি আকড়িয়ে থাকার যে ক্ষমতা সেটা না থাকায় ফলমত গাছ অতি সহজেই ঝড়ে বা বাতাসে গোড়াসহ উপড়ে পড়ে যায়।

দমন ব্যবস্থা:

পানামা প্রতিকারঃ রোগমুক্ত চারা রোপণ করতে হবে। রোগাক্রানত গাছ শিকড় ও চারাসহ তুলে জমি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ করতে হবে। আক্রামত জমিতে ৩-৪ বছর কলার চাষ করা যাবে না। জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে। তিন মাস পানি দ্বারা ডুবিয়ে রাখলে জমিকে রোগমুক্ত করা যায়।

সিগাটোকা প্রতিকারঃ রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ করতে হবে।আক্রামত পাতা বা পাতার অংশ বিশেষ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সঠিক দূরত্বে গাছ লাগানো যাতে বাগানের সব কলা গাছ ঠিকমত আলো-বাতাস পায়। গাছের পাতায় রোগের লক্ষণ দেখা দিলে স্কোর প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মি.লি. অথবা নোইন বা ব্যাভিষ্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা একোনাজল/ফলিকোর প্রতি লিটার পানিতে ০.১ মি.লি. মিশিয়ে ১৫-২০ দিন অমতর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

হার্ট রট প্রতিকারঃ রোগমুক্ত চারা রোপণ করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত, সুনিষ্কাশিত ও পর্যাপ্ত আলো-বাতাসযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে চারা রোপণ করতে হবে। আক্রান্ত গাছ উপড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে।

বানচি টপ বা গুচছ মাথা রোগ প্রতিকারঃ বাঞ্চি টপ রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ করতে হবে। রোগ মুক্ত চারা রোপণ করতে হবে। ভাইরাসের বাহক জাব পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড (এডমায়ার ২০০ এসএল) (প্রতি লিটার পানিতে ০.২৫ মি.লি.) অথবা রিপকর্ড (প্রতি লিটার পানিতে ১ মি.লি.) ১৫ দিন অমতর গাছে স্প্রে করতে হবে। আক্রামত গাছের গোড়া সাকারসহ উঠিয়ে কুচি কুচি করে কেটে শুকিয়ে পুড়িয়ে ফেলা। রোগাক্রামত গাছের সাকার রোপণ না করা।

কৃমি রোগ বা নেমাটোড প্রতিকারঃ২-৩ বছরের জন্য শস্য পর্যায় অনুসরণ। কলা গাছ গোড়াসহ উঠিয়ে আক্রামত জমি ৬-৮ সপ্তাহ পানিতে ডুবিয়ে রাখা। ১০-১২ মাসের জন্য কলার জমি পতিত রাখা। রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষকরা। রোগমুক্ত জমি হতে সুস্থ সবল চারা সংগ্রহ। টিস্যুকালচারের মাধ্যমে তৈরি চারা ব্যবহার। আক্রামত চারা ব্যবহার করলে সে ক্ষেত্রে লাগানোর আগে চারার গোড়ার কাল দাগ সম্পূর্ণ চেঁছে ফেলা। আক্রামত চারা গরম পানিতে (৫৫% সেঃ তাপমাত্রায় ২০ মিনিট) ডুবিয়ে রাখা। বছরে ৩-৪ বার জমিতে ফুরাডান ৫ জি বা বিস্টাবেন ৫ জি (৪৫-৬০ কেজি প্রতি হেক্টর) বা রাগবি ১০ জি (৩০ কেজি প্রতি হেক্টর) প্রয়োগ করা।

পোকামাকড় দমন ব্যবস্থা

পোকামাকড়
কলার পাতা ও ফলের বিটল পোকাঃ পূর্ণাঙ্গ বিটল কচি পাতা ও কচি কলার সবুজ অংশ চেঁচে খেয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাগ সৃষ্টি করে। কলা বড় হওয়ার সাথে সাথে দাগগুলো আকারে বড় হয় এবং কালচে বাদামী রং ধারণ করে। কলার গায়ে বসন্ত দাগের মত দেখায় এবং এর বাজার মূল্য কমে যায়।

দমন ব্যবস্থা
কলার পাতা ও ফলের বিটল পোকা প্রতিকারঃ মোচা বের হওয়ার সাথে সাথে একবার, ছড়ি থেকে প্রথম কলা বের হওয়ার পর একবার এবং সম্পূর্ণ কলা বের হওয়ার পর আরো একবার মোট তিনবার ডায়াজিনন ৬০ ইসি (প্রতি লিটার পানিতে ২ মিঃ লিঃ) বা ফেনভেলারেট জাতীয় কীটনাশক (ফেনফেন২০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ মি.লি.) স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যেতে পারে। এছাড়া ছিদ্রযুক্ত পলিথিন দিয়ে কলার কাঁদি ব্যাগিং করে এ পোকার আক্রমণ থেকে কলাকে রক্ষা করা যায়। এ ক্ষেত্রে মোচা থেকে কলা বের হওয়ার আগেই কাঁদির চেয়ে বড় আকারের দু’মুখ খোলা বিশিষ্ট ছিদ্রযুক্ত পলিথিন ব্যাগের এক মুখ দিয়ে মোচাকে আবৃত করে কাঁদির সাথে আলতোভাবে বেধে দিতে হয় এবং নীচের দিকের মুখ খোলাই থাকে। নীচের মুখ খোলা থাকলে মোচার উচ্ছিষ্ট অংশ সহজে নীচে পড়ে যেতে পারে। পলিথিন ব্যাগে ০.৫-১.০ সেঃমিঃ ব্যাস বিশিষ্ট কমপক্ষে ২০-২৫ টি ছিদ্র রাখতে হবে যাতে কাঁদির ভিতর সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে। কাঁদি সম্পূর্ণ বের হওয়ার এক মাস পর ইচছা করলে পলিথিন খুলে ফেলা যায়। তখন কলার চামড়া শক্ত হয়ে যায় বিধায় বিটল পোকা কোন ক্ষতি করতে পারে না। এ প্রযুক্তি শীতকালে ব্যবহার করলে কলা আকারে বড় হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়।

সার ব্যবস্থাপনা
মধ্যম উর্বর জমির জন্য গাছ প্রতি গোবর/আবর্জনা পঁচাসার ১০ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ৬০০ গ্রাম, জিপসাম ২০০ গ্রাম, জিঙ্ক অকা্রাইড ১.৫ গ্রাম ও বরিক এসিড ২ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। উলি­খিত পরিমাণের সর্ম্পুণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিঙ্কঅক্সাইড ও বরিক এসিড এবং অর্ধেক এমওপি সার গর্ত তৈরির সময় গর্তে দিতে হয়। ইউরিয়া ও বাকী অর্ধেক এমওপি চারা রোপণের ২ মাস পর থেকে ২ মাস পর পর ৩ বারে এবং ফুল আসার পর আরও একবার গাছের চর্তুদিকে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। সার দেয়ার সময় জমি হালকাভাবে কোপাতে হবে যাতে শিকড় কেটে না যায়। জমির আর্দ্রতা কম থাকলে সার দেয়ার পর পানি সেচ দেয়া একামত্ম প্রয়োজন।

**প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলুন।

সূত্র: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।

This post has already been read 3860 times!

Check Also

জলঢাকায় সোনালী ধানের শীষে দুলছে কৃষকের স্বপ্ন

বিধান চন্দ্র রায় (নীলফামারী) : নীলফামারীর জলঢাকায় মাঠের যে দিকে চোখ যায়, সেদিকেই সবুজের সমারোহ। …