ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : স্বাধীনতার তিন বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃত্রিম প্রজননের আওতায় গবাদিপশুর বীজ (সিমেন) গ্রাম পর্যায়ে বিতরণের লক্ষে মহানগরীর আড়ংঘাটার থানা এলাকার গাইকুড়ে ১.০৯ একর জমির উপর স্থাপিত হয় খুলনা জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রটি।
বর্তমানে কেন্দ্রটি ৩টি জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার ২১ টি উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিসেবা প্রদান করছে। এই কেন্দ্রের তত্ত্ববাধায়নে জেলা কেন্দ্র খুলনা, দিঘলিয়া, ফুলতলা, রূপসা, বটিয়াঘাটা, তেরখাদা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, দাকোপ, কয়রা, সাতক্ষীরা, কলারোয়া, তালা, দেবহাটা, আশাশুনি, শ্যামনগর, বাগেরহাট সদর, ফকিরহাট, মোল্লারহাট, কচুয়া, মোরেলগঞ্জ, চিতলমারী, শরণখোলা ও মোংলাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পর্যায়ে ৩৯ জন সরকারি এ.আই (মাঠ কর্মী) ও ১৭১জন ও এ.আই টেকনিশিয়ান এর মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজননের আওতায় গবাদিপশুর বীজ (সিমেন) গ্রাম পর্যায়ে বিতরণে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
প্রজনন কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, বিগত ২০১৯ সালের প্রথমদিকে অত্র কেন্দ্র হতে ৪টি হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের ষাড় কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার ঢাকা সাভারে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। কারণ একটি ষাড় হতে সংগ্রহকৃত ৫ এম.এল সিমেনকে ১২৫ এম.এল ডায়লুটেড তৈরী করা হতো এই তরল সিমেনের স্থায়ীত্ব ছিল ২/৩দিন। কিন্তু যখন এটাকে হিমায়িত করা হয়, তখন প্রতিটি গাভীর জন .২৫ এম.এল হিসাবে ৫এম.এল ষাড়ের বীর্যকে ৫০০টি প্রজননের সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়েছে এবং যা তরল নাইট্রোজেনের মাধ্যমে ২৫/৩০ বছর পর্যন্ত স্থায়ীত্ব করা সম্ভব হয়েছে। ফলে সরকারের আর্থিক সাচ্ছ্যন্দতার জন্য অত্র সেন্টার হতে ষাড় গুলো কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অত্র প্রতিষ্ঠান হতে গত ২০২১-২২ অর্থ বছরে এপ্রিল ২২ পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৮,৫৪,৩১০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এপ্রিল ২২ পর্যন্ত খুলনায় কৃত্রিম প্রজনন ৩৭৯৫৭, সাতক্ষীরায় ৫৬৯৪৪ ও বাগেরহাটে ২৬০৪২ একই সাথে বাচ্চা উৎপাদন হয়েছে খুলনায় ১৮৩০১ সাতক্ষীরায় ২৮৪৬০ ও বাগেরহাটে ১০২০৩ টি।
খুলনা প্রজনন কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আলমগীর হোসেন জানান, অত্র সেন্টার হতে খুলনার তিনটি জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এ.আই ও এ.আই টেকনিশিয়ানের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ে নাম মাত্র ৩০ টাকার বিনিময়ে সিমেন প্রদান সেই সাথে সম্পূর্ন ফ্রি হ্যান্ড গ্লোভস্, শীথ, এ.আই গান, সিজারস্, ফরসেফ, থার্মোমিটার, হট ওয়াটার বয়লার, রেইনকোট, বুট সহ অন্যান্য সরজ্ঞামাদী দেওয়া হয়ে থাকে। সিমেন (বীজের) ৪টি গ্যাটাগরির হয়ে থাকে, ১০০% হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান (বিদেশ হতে আমদানিকৃত) জাতের সিমেন, ৭৫% হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের সিমেন, ৫০% বা ৬২.৫% হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের সিমেন ও পাকিস্তানি শাহী ওয়ান জাতের সিমেন সরবরাহ করা হয়ে থাকে। প্রতি মাসে কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার ঢাকা সাভার সেন্টার হতে ৩৫২৮ লিঃ তরল নাইট্রোজেন ও ১৬ হতে ১৭ হাজার মাত্রায় সিমেন (বীজ) আসে। অত্র সেন্টার হতে ৩ জেলার দায়িত্বরত ২১০ জন কর্মীর মধ্যে ১৫ লিঃ করে তরল নাইট্রোজেন জারে রিফিল করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি এ সকল কর্মীগন মাঠ পর্যায়ে তালিকা করে তাদের প্রয়োজনের তুলনায় উক্ত কেন্দ্র হতে সিমেন বা বীজ সংগ্রহ করে থাকে।
সরকারি এই প্রজনন কন্দ্রের পাশাপাশি বেসরকারি কয়েকটি প্রজনন সেন্টারও রয়েছে। যার মধ্যে ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র, এ.সি.আই এ্যানিমেল জেনোটিক্স, আমেরিকান ডেয়রী লিঃ, লালতীর লাইফস্ট্রক ডেভেলপমেন্ট ও এজাব এ্যালাইসপ্ লিঃ নামের প্রতিষ্ঠান। যারা ৪/৫ বছর হলো মাঠ পর্যায়ে প্রজননের কার্যক্রম পরিচালিত করছে। তিনি জানান, বেসরকারি এই সংস্থা গুলো খামারী ও প্রান্তিক গৃহস্থালীদের ভুল বোঝায় যে, সরকারি সিমেন ১০০% কার্যকর নয়। তবে ১০০% হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান পালতে হলে একজন খামারিকে পর্যাপ্ত সবুজ ঘাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে, ঠান্ডা পরিবেশ ( ফ্যান, ফগিং সিস্টেম) থাকতে হবে, গাভীর শারিরিক চর্চার ব্যবস্থা থাকতে হবে, খামারিকে মানবিক হতে হবে।
খুলনা জেলায় কৃত্রিম প্রজননের আওতায় গবাদিপশুর বীজ (সিমেন) গ্রাম পর্যায়ে বিতরণে বাহা বাহা কুড়ালেও কিছু অভিযোগের কথা ও জানা গেছে। ৩০ টাকা মূল্যের সরকারি প্রজনন বীজ ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবীরা গ্রামের গৃহস্থালীদের নিকট হতে নেওয়া কথা থাকলে তা নেওয়া হচ্ছে বহুগুনে। জানা যায়, কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের সিমেন (বীজের) ১০০% হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান (বিদেশ হতে আমদানিকৃত) জাতের সিমেন, ৭৫% হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের সিমেন, ৫০% বা ৬২.৫% হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের সিমেন ও পাকিস্তানি শাহী ওয়ান জাতের এই ৪টি ক্যাটাগরির যে কোনটির মূল্যই মাত্র ৩০ টাকা। যদিও এ.আই বা এ,আই টেকনিশিয়ানরা ৩০ টাকার ব্যাংক চালান কেটে খুলনা উপজেলা অফিসে জমা দেয় আর উপজেলা অফিস তা জেলা অফিসে জমা দেয়। এভাবে খাতা কলমেও রাজস্ব সরকারি ভাবে জমা হলেও প্রান্তিক খামারি বা গৃহস্থালীদের নিকট হতে ৫/৬’শ টাকায় বিক্রি করেন সরকারি নির্ধারিত ৩০ টাকা মূল্যের সিমেন (বীজ) বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্ধারিত মূল্য ব্যতিরেকে বীজ কিনতে গিয়ে গবাদিপশু পালনকারী গৃহস্থ ও খামারিরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন বলে অভিমত রয়েছে।
কথা হয় সাতক্ষীরা তালা জিয়ালা নলতার খামারী রফিকুলের সাথে। তিনি জানান, তার স্বল্প পরিসরে ১৩টি গবাদীপশুর খামার রয়েছে। যদিও তাকে সরকারি সিমেন খরচ সম্পর্কে বলা হয়নি। তিনি কত টাকার মাধ্যমে সিমেন (বীজ) প্রজনন করান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১০০% হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের সিমেন বা প্রজনন করা ৫/৬ টাকায় আর ৭৫% হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের সিমেন করান আড়াই’শ হতে ৩’শ টাকায়। কিন্তু যার প্রকৃত দাম মাত্র ৩০ টাকা।
মুঠো ফোনে কথা হয় এ.আই (মাঠ কর্মী) শহিদুল ইসলামের সাথে। তিনি সত্যতা স্বীকার করে প্রতিবেদককে জানান, হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের সিমেন ৪ ক্যাটাগরি থাকলে ও বেশি ভাগ ক্ষেত্রে ১০০% ও ৭৫% প্রয়োগ করা হয়। সরকারি ফি মাত্র ৩০ টাকা হলেও ক্যাটাগরি অনুসারে আড়াই’শ হতে ৩’শ আর ৫শ থেকে ৬’শ টাকায় প্রজনন করা হয় বলে জানান। এভাবে কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। খুলনা জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের উপ-পরিচালক ডা.সুষেন হালদার জানান, বর্তমান সরকার কৃষি বান্ধব সরকার। ইতিমধেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গেছে। গবাদীপশুর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার নানামুখি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বর্তমানে এই কেন্দ্র হতে ২১০ জন মাঠ কর্মীর মাধ্যমে ৩টি জেলার উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গবাদীপশুর কৃত্রিম প্রজনন পরিসেবা প্রদান করা হচ্ছে। এই প্রজননে সরকারকে ভর্তুতি গুণতে হচ্ছে। একটি সিমেন হাইড্রোজেন প্রয়োগে খরচ হয় প্রায় ৩’শ টাকার মতো কিন্তু নেওয়া হচ্ছে মাত্র ৩০ টাকা। বেসরকারি প্রজনন কেন্দ্র গুলো এসেছে ব্যবসার জন্য সেবার জন্য নয়।
ইউনিয়ন পর্যায়ে সেচ্ছাসেরীরা ৩০ টাকার বীজ নির্ধারিত টাকার পরিবর্তে ৫/৬’শ টাকা নেওয়া হচ্ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের দেশের ক্রমশইঃ শিক্ষিত বেকার বাড়ছে। এই সকল বেকারা যাদের আগ্রহ আছে তাদের মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজননের ওপর ৬ মাসের প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়েছে থাকে। অতঃপর প্রশিক্ষন শেষে কাজে যোগদানের পর মাসিক ২০০০ টাকা সন্মানী দেওয়া হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় বাজেট না থাকায় ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীদের ২০২১-২২ সালের অর্থ বছরের সম্মানী প্রদান করা করা হয়নি, বকেয়া রয়েছে। তবে ইউনিয়ন পর্যায়ে এই সেচ্ছাসেবকরা ৩০ টাকার সিমেন ৫/৬’শ টাকায় বিক্রি করে কিনা এ ব্যাপারে আমি অবগত নয়।