কক্সবাজার সংবাদদাতা: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফ এ ও , ২০২২ সাল কে আর্টিসানাল ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচারের আন্তর্জাতিক বছর (আই ওয়াই এ এফ এ ২০২২) হিসাবে ঘোষণা করেছে। আই ওয়াই এ এফ এ ২০২২ উদযাপনের অংশ হিসাবে কক্সবাজারের একটি হোটেলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘নোনা জলের কাব্য’-এর একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল।
প্রদর্শনীতে ‘নোনা জলের কা্ব্য’ চলচ্চিত্র নির্মাতা রেজয়ান শাহরিয়ার সুমিতের উপস্থিতিতে, আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথিদের সাথে ৪০ জন মৎস্যজীবী চলচ্চিত্রটি উপভোগ করেন।
লাখো ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী, মৎস্য চাষী আর এ পেশার সাথে সংশ্লিষ্টদের কাজের গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি দেয়াই বিশ্বব্যাপী আই ওয়াই এ এফ এ ২০২২ উদযাপনের লক্ষ্য। কারণ, এ মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কঠোর পরিশ্রমেই কোটি কোটি মানুষের কাছে স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাদ্য পৌঁছে যায় আর তা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য, ক্ষুধা মুক্তি অর্জনে অবদান রাখে। অথচ দৃশ্যমান কৃষি খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমের আড়ালে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে আর অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে।
ছোট-বড় মৎস্যজীবী পরিবার এবং স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের সমন্বিত মাছ ধরা কর্মসূচি আর জলজ প্রতিপালন হল বাংলাদেশের মৎস্য খাতের মেরুদণ্ড। যা দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং টেকসই প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখছে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফ এ ও প্রতিনিধি রবার্ট ডি. সিম্পসন বলেন, “এফএও-এর পক্ষ থেকে, আমি বাংলাদেশের সকল ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের তাদের অবিশ্বাস্য অবদান এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। “তিনি মনে করেন ,”ক্ষুদ্র আকারে মৎস্যচাষে পরিবেশের উপর প্রভাব সাধারণত মৃদু হয় তবুও এই মৎস্যজীবীরাই ক্রমবর্ধমানভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব যেমন – চরম আবহাওয়া, বন্যা এবং খরা ইত্যাদির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের কণ্ঠস্বর সবার কাছে পৌঁছে দেয়া জরুরি এবং বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী সংলাপে তাদের মতামতকে সমন্বিত করা প্রয়োজন।”
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি জেলে পল্লীর পটভূমিতে নির্মিত “নোনা জলের কাব্য (দ্য সল্ট ইন আওয়ার ওয়াটারস ) চলচ্চিত্রটির কাহিনী জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাবের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। গত বছর যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (COP26) সিনেমাটির একটি প্রদর্শনী হয়েছিল।
এফ এ ও আয়োজিত কক্সবাজারের এই প্রদর্শনীতে চলচ্চিত্রটির নির্মাতা, কলাকুশলীদের সাথে, মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতবিনিময় হয়। নির্মাতা জেলেদের জীবনের গল্প, আবহাওয়া পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ কিভাবে চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। এছাড়াও প্রদর্শনীতে আরও উপস্থিত ছিলেন, মৎস্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাগণ।
চলচ্চিত্রটির নির্মাতা রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত বলেন, “ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের ছবিটি পৌঁছে দেয়ার একমাত্র উপায় হল, তারা যেখানে থাকেন সেখানে সিনেমাটি নিয়ে যাওয়া। “বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আমরা এ চলচ্চিত্রটির একটি সিরিজ প্রদর্শনী করেছি । এফ এ ও কে ধন্যবাদ কক্সবাজারের মৎস্যজীবীদের কাছে সিনেমাটি পৌঁছে দেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।”
তিনি ছোট আকারের মৎস্যজীবীদের অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন , “ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের সাথে বহু মাস সময় পার করার পরে, আমি বুঝতে পেরেছি যে তারা নানান বাধায় জর্জরিত হতে পারেন কিন্তু সেটাই তাদের গল্পের সবটুকু নয়। তারা অদম্য সাহসী, আঘাত সহনশীল ,মেধা মননে সমৃদ্ধ, জীবনে যাপনে রঙিন, আশা এবং স্বপ্ন আর সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ।”
সুমিত আরও বলেনঃ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের সমুদ্র সৈকত একদিকে যা প্রকৃতিকে পুনরুদ্ধার করে আবার দুর্যোগের আভাস দেয়, তা আমাদের প্রজন্মকেই রক্ষা করতে হবে। আমরাই পারি যারা প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে।
কক্সবাজারের ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সুমি আক্তার (২৫) চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে বলেন “ সিনেমাটা আমার খুব ভাল লেগেছে,মনে হল একদমই আমাদের জীবনের গল্প। মানুষ যে আমাদের কথা ভাবছে, আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছে এটাতেই অনেক খুশি লাগছে।“
এফ এ ও বাংলাদেশের এসব প্রান্তিক ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের আঘাত সহনশীল করে গড়ে তুলতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মাছের বাস্তু সংস্থানে এবং মৎস্যজীবীদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কিভাবে কাজ করছে তা বোঝার জন্য দেশব্যাপী পর্যালোচনা চলছে। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণতার মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক জলবায়ু অভিযোজনের বিকল্প পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করবে। সেই সাথে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের বাস্তু সংস্থান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রস্তুত করবে। সেই সাথে এফ এ ও মৎস্য ও জলবায়ু সহনশীলতার উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করছে, যা গত বছরে ৩০০০ জেলে পরিবারের কাজে এসেছে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এবং হাওর অঞ্চলের ২৫০০ পরিবারে জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তির পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এলাকা ভিত্তিক স্থানীয় সংস্থা গড়ে তুলেছে।
এফএও মৎস্যজীবীদের দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনা উন্নত করার চেষ্টা করে চলেছে। বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায়, এফ এ ও বিদ্যমান আগাম সতর্কতা ব্যবস্থায় মৎস্য ও জলজ প্রতিপালনকে একীভূত করছে।২০২৩ সাল নাগাদ, এফ এ ও জলবায়ু বিপত্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মৎস্য ও জলজ পালনের পরামর্শ ৪০০০০০ লোকের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে।