সোমবার , ডিসেম্বর ২৩ ২০২৪

ভার্মি কম্পোস্ট করে স্বাবলম্বী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মাহাবুব মল্লিক

আব্দুল মান্নান (শরীয়তপুর) : শরীয়তপুর নড়িয়া উপজেলার চরআত্রায় কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন করে বেকারত্ব দূর করার পাশাপাশি নিজের ভাগ্য বদল করেছেন জন্মান্ধ মো. মাহাবুব মল্লিক। জন্মের পর থেকে মাহাবুব মল্লিকের দুই চোখ নষ্ট। নদীভাঙনে বিপর্যস্ত বাবা-মায়ের অভাবী সংসার আর আর্থিক-অনটনের মধ্যেই চরাঞ্চলে বড় হয়ে ওঠা মাহাবুব মল্লিকের চোখের চিকিৎসা করানোর ইচ্ছা থাকলেও অভাবের তাড়নায় সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। যেখানে ক্ষুধার জ্বালা মেটানো দায় ছিল সেখানে চোখের চিকিৎসা করানো তার জন্য বিলাসিতা। তাই দুনিয়ার আলোবাতাস দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। জীবনের প্রতিটি ধাপে লড়াই-সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়েছে তাকে। কখনো কখনো দুর্বিষহ জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে শেষ করেও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। সহ্য এবং ধৈয্য ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা হয়তো তার কোন পরীক্ষা নিয়েছেন।

মাহাবুব মল্লিক (৪৫) বর্তমানে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে চরআত্রা নামক একটি গ্রামে বসবাস করছেন। থাকার জন্য ২টি ঘর আর আবাদের জন্য ৮ শতক জমি ছাড়া নিজস্ব সম্বল বলতে তার আর কিছুই নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় অন্যের মাঠে বা দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবেন এমন সুযোগও নেই তার। একমাত্র স্ত্রী এসডিএস এর অফিসে বুয়া/বাবুর্চি হিসেবে মাসে যে টাকা পায় তাই দিয়েই তাদের ৪ সদস্যের সংসার চালানো দুরূহ। তাই কাঙিখত আয়-রোজগার না থাকায় মানবেতর জীবন যাপন করতে হয় তাদের। ইচ্ছা থাকলেও কখনো ভালো পোশাক বা খাবার কিনে খাওয়ার সাধ্য নেই তাঁদের। তদুপরি দুই সন্তানের লালন-পালন যেন দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠে।

তার এই করুণ অবস্থার কথা জানতে পেরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এসডিএস ২০২০ সালে পিকেএসএফ এর সহযোগিতায় পরিচালিত PACE প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ পদ্ধতিতে সাধারণ ও উচ্চমূল্যের সবজি চাষের মাধ্যমে কৃষকের আয়বৃদ্ধিকরণ উপ-প্রকল্প থেকে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির জন্য তাকে ২ টি চারি/রিং এবং কিছু কেঁচো কিনে দেয়।পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগে তিনি (মাহাবুব) আরও ৩টি চারি যুক্ত করে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করেন।

এ বিষয়ে প্রকল্পের এভিসিএফ সুব্রত মজুমদার জানান,  PACE প্রকল্পের আওতায় আমরা অনেককে ভার্মি কম্পোস্ট, নার্সারিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী দিয়েছি। যারা সাধারণ ভার্মি কম্পোস্ট পেয়েছে তাঁদের মধ্য থেকে উৎপাদন ও বিপণনে এগিয়ে আছেন মাহাবুব।প্রতি মাসে তিনি ৪০০/৫০০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) উৎপাদন করেন। প্রতি কেজি বারো টাকা দরে গড়ে ৪-৫ হাজার টাকা বিক্রি হয় এই কম্পোস্ট। উৎপাদিত এই কম্পোস্ট জেলার বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে।নিজেদের সবজি ক্ষেতে ব্যবহার করার জন্য গ্রামের কৃষকরাও তার কাছ থেকে উন্নতমানের এই ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) কিনছেন।এতে কৃষকরাও উপকৃত হচ্ছেন।এর ফলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমছে আর কেঁচো সার ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, ফসলের ক্ষেতে রাসায়নিক সার ব্যবহারে অতিরিক্ত ব্যয় করতে গিয়ে কৃষকরা যখন দিশেহারা হয়ে পড়ছিলেন, ঠিক তখনি স্বল্প মূল্যের কেঁচো দিয়ে তৈরিকৃত সার মিলছে হাতের নাগালে। এতে ভালো ফসল এবং উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ায় কৃষকেরা নিরাপদ সবজি চাষের দিকে দিন দিন ঝুঁকে পড়ছেন।তাতে করে ভাগ্য বদলাতে শুরু করে মাহাবুব মল্লিকের।

মাহাবুব মল্লিক বলেন, ‘এসডিএস এর সুব্রত ভাইয়ের সহযোগিতায় ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন, কেঁচো, গোবর সংগ্রহ, রিং, স্লাবে দেয়া, কম্পোস্ট তৈরির পর সেগুলো সংগ্রহ করা, কম্পোস্ট প্যাকেজিং এবং বাজারজাতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রথমে নিজের আবাদি জমিতে ব্যবহারের জন্য স্বল্প পরিসরে উৎপাদন শুরু করি। দিন দিন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করে আমি বেশ লাভবান হয়েছি। প্রতি কেজি সার ১২ টাকা দরে এবং কেঁচো ৮০ পয়সা দরে বিক্রি হয়।এতে প্রতি মাসে গড়ে ৪-৫ হাজার টাকা আমি বাড়িতে বসে আয় করতে পারি। আমার কাজে আমার স্ত্রীকে আমাকে সহযোগিতা করে।এখন আগের থেকে আমার পরিবার সচ্ছল হয়েছে। আমার দেখাদেখি এলাকার আরও অনেকে এই কাজ শুরু করেছেন। তারাও ভাল করছেন। আগে অনেকে বেকার ছিল, তারা এই সার উৎপাদন করে বর্তমানে ভাল আয়-রোজগার করছেন।’

ভার্মি কম্পোস্ট সম্পর্কে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকৃতির লাঙ্গল হিসেবে পরিচিত কেঁচো এবং গোবরই ভার্মি কম্পোস্টের প্রধান উপকরণ। সিমেন্টের তৈরি রিং/চারিতে পরিমাণ মত গোবরের সঙ্গে কেঁচো ছেড়ে চটের বস্তা দিয়ে এক মাস ঢেকে রাখলেই তৈরি হয় উন্নত মানের ভার্মি কম্পোস্ট তথা কেঁচো সার। বর্তমানে রাসায়নিক সারের অতিব্যবহারে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু এই কম্পোস্ট মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমেছে। এই কম্পোস্ট ব্যবহারে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। এতে একদিকে যেমন ফসলের উৎপাদন ভালো হচ্ছে, অন্যদিকে রায়সানিক সারের জন্য  বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে না কৃষকদের। ফলে এই সারের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে এসডিএস প্রয়োজনীয় উপকরণ, প্রশিক্ষণ ও কেঁচো দিয়ে কম্পোস্ট উৎপাদনে সার্বিক সহযোগিতা করে আসছে।

This post has already been read 3116 times!

Check Also

স্নাতক পাশ করেই নার্সারী থেকেই পিন্টুর মাসিক আয় ৫ লাখ টাকা

মিঠুন সরকার (যশোর সংবাদদাতা) : কৃষি কাজকে অনেকে কটুক্তির চোখে দেখলেও স্নাতক পাশ করেই কৃষিতে …