নিজস্ব প্রতিবেদক: যে ব্যবসার জন্য নিজেদের জীবন যৌবন বিলিয়ে দিলাম, বাপ-দাদা সম্পত্তি নস্ট করলাম, মানুষের পুষ্টির সবচেয়ে সস্তায় প্রোটিন সরবরাহ করলাম, দেশের মানুষের কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখলাম- দেশের মানুষের কাছে সেই আমরাই এখন আসামীর কাঠগড়ায়। বিগত কয়েকদিন ডিমের বাজার নিয়ে আমাদের খামারিদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, আমরা বিরাট কোন অপরাধী। অথচ বিগত দুই বছর ধরে এই ব্যবসায় লোকসান দিতে দিতে আমাদের অনেকেই এখন ঘড়বাড়ি ছাড়া, ঋনের বোঝায় জর্জরিত; আশার আলো দেখার অপেক্ষায় কেউ কেউ পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে বিনিয়োগ করছে। পোলট্রি আমাদের জন্য কেবল একটি ব্যবসা না, এটি আমাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে; হাজার লোকসানের পরও চাইলেও অজানা এক মায়ার টানে ছেড়ে যেতে পারি না। যারা ডিম ও মুরগির দাম নিজেরা নির্ধারণের ক্ষমতা রাখেনা, সেই খামারিরা কেন আজ আসামী?
সোমবার (২২ আগস্ট) বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ এর আয়োজনে রাজধানীর কেআইবি মিলনায়তনে ‘পোলট্রি শিল্পের বর্তমান সংকট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন উপস্থিত প্রান্তিক পোলট্রি খামারিগণ। পরিষদের ঢাকা বিভাগের সভাপতি কামালউদ্দিন নান্নুর সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন—প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. মোসাদ্দেক হোসেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা খামারি মো. আলমগীর হোসেন স্বপন, আব্দুর রহিম গাজী, শহিদুল হক, এমরান হোসেন, মাহবুব আলম, ফয়েজ আহসেদ, মো. আসরাফিল, সুজন চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান, ইঞ্জিনিয়ার জোয়ারদার প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মোহসিন।
আলোচনা সভায় উপস্থিত খামারিগণ বলেন, ডিম ও মুরগি উৎপাদন করি আমরা কিন্তু এর মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে অন্যরা। অথচ সম্প্রতি ডিমের দাম বেড়ে যাওয়াতে আমরা প্রান্তিক খামারিরা সমালোচনার শিকার হচ্ছি। ভোক্তা অধিকারের অভিযানে হয়রানির শিকার হচ্ছি, এমনকি অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে। ডিমের বাজার ভোক্তার হাতের নাগালে থাক সেটি আমরাও চাই। মুরগি পালনের অন্যতম উপকরণ খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম অত্যাধিক বেড়ে যাওয়াতে একটি ডিম উৎপাদনে আমাদের বর্তমানে প্রায় ৯ টাকা ৮০ পয়সার মতো খরচ হয়। সেটি আমরা সাড়ে দশ থেকে এগারো টাকায় বিক্রি করতে পারলেই খুশি। আমরা ডিমের দাম পেয়েছি ৯-১০ টাকা, সেই ডিম খুচরা পর্যায়ে কীভাবে ১৫ টাকা হলো সেটি আমাদেরও প্রশ্ন।
খামারিগণ আরো বলেন, ডিমের দাম আমাদের নির্ধারণের ক্ষমতা দিতে হবে। অথবা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় খামারীদের সাথে বসে উৎপাদন খরচে সাথে সামঞ্জস্য রেখে দাম ঠিক করে দিক। আমরা সেটিই মানবো।
তাঁরা অভিযোগ করে বলেন- ক’দিন পর পর খাদ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে; কিন্তু কেন বাড়াচ্ছে, কারা বাড়াচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এ ব্যাপারে একটি টু শব্দও শুনলাম না। আমাদের দুঃখ হয় আমরা কি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়েই আছি না অন্য কোন মন্ত্রণালয়ে আছি সেটিই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার, খামারি ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা মিলে একটি কমিটি করে দেয়া হউক যারা প্রতি মাসে একবার ডিমের দাম নির্ধারন করে দিবেন এবং আমরা সেটিই মানবো।
টাঙ্গাইলের ভূঁয়াপুর থেকে আগত খামারি মো. আলমগীর হোসেন স্বপন বলেন, আমাদের অবস্থা হয়েছে ছোটবেলার সেই বানরের অংকের মতো। মাঝে মাঝে এক ব্যাচে একটু লাভ হলে দু হাত উঠলে পরবর্তী দুই ব্যাচে লোকসান দিয়ে তিন হাত নিচে নামি। আজ থেকে ৩০ বছর আগে ছাত্রাবস্থায় পোলট্রি খামার ব্যবসা শুরু করি। সেই সময় ভালোই চলছিল, আমার দেখাদেখি আমাদের উপজেলায় প্রায় ৪-৫শ’ খামারি তৈরি হয়েছে। আর বর্তমানে ১০-১২ গ্রাম ঘুরলেও একটি খামারি পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। লোকসান দিতে দিতে সিংহভাগ খামার বন্ধ হয়ে গেছে, পাওনাদারের ভয়ে অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই এদেশের মানুষকে ২০ টাকা প্রতি পিস ডিম কিনে খেতে হবে।
’এদেশের কৃষক-খামারি কখনো সিন্ডিকেট করতে পারেন না; সিন্ডিকেট করেন এক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী। এদেশের ধনীক শ্রেণীর পোলট্রি ব্যবসায়ীরা চান না প্রান্তিক খামারিগণ টিকে থাকুক। এছাড়াও আরেকটি শ্রেণী আছে যারা ওৎ পেতে বসে আছেন যে, কখন এদেশের প্রান্তিক খামারিরা নিঃশেষ হয়ে যাবে। কারণ, এ দুটো শ্রেণীই তখন ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দার্ম নির্ধারন করে একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারবে’- যোগ করেন আলমগীর হোসেন স্বপন।
বরিশাল থেকে আগত অপর এক খামারি আব্দুর রহিম গাজী যিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ছিলেন তিনি বলেন, খামারের প্রতি আমাদের মায়া জন্মে গেছে। মুরগির দিকে তাকালে ও ডাক শুনলে অদ্ভূত রকমের এক নেশা কাজ করে। যে কারণে বারবার লোকসান দেয়ার পরও পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংক ঋণের এক কোটি টাকা জমা দিয়েছি। এরপরও ভোক্তা অধিকারের অভিযানে আমাদের মতো বয়োবৃদ্ধ লোকদেরকেও অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুনতে হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের লোকজনতো আমাদেরকে মানুষই মনে করে না। এদেশের খামারিরা এখন সবচেয়ে বেশি অসহায়। আমরা এখন নিঃস্ব হওয়ার পথে; তাই সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি পরিবারের কাছেও এখন আর আমাদের কোন মূল্য নেই।
প্রধান আলোচক ডা. মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, আমাদের দেশের প্রান্তিক খামারিরা জোটবদ্ধ না, তারা অসহায়। বর্তমানে পোলট্রি খাদ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। একটি ডিমের উত্পাদন খরচ পড়ছে সাড়ে ৯ টাকার বেশি। কিন্তু একজন প্রান্তিক খামারি কত টাকায় তার ডিম বিক্রি করছেন। এ খবর কয় জন রাখেন? এ সময় তিনি পোলট্রি সেক্টরে টিকে থাকতে হলে, খামারের ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার ব্যাপারে জোর দিতে হবে বলে, জানান।
খন্দকার মো. মোহসিন বলেন, বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কয়েকটি এনজিও, বিশ্ববিদ্যালয় ২০১০ সনের জুন মাসে যৌথভাবে একটি জরিপ চালায় যেখানে দেশে মোট ১ লাখ ১৪ হাজার ৭শ’ ৬৩টি পোলট্রি খামারের সংখ্যা আমরা পাই। সাম্প্রতিক সময়ে সেটি নেমে এসেছে প্রায় ৭৯ হাজারে। দেশের প্রায় ৭৮ ভাগ ডিম ও মুরগি সরবরাহ করে থাকেন প্রান্তিক খামারিরা। কাঁচামাল ও ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে ফিডের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে, ফলে ডিম ও মুরগি উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে গেছে। খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে অবশিষ্ট খামারিরা এখন শংকিত তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে কি না!