বুধবার , ডিসেম্বর ১৮ ২০২৪

ধানের ফলন ৪০ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানোর দাবী চায়নীজ গবেষকদের

কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন : নিপ্পনবেয়ার নামক একটি চীনা ধানের জাতকে তার নিজস্ব জিনের দ্বিতীয় অনুলিপি ইনসার্ট করে ফলন ৪০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়েছেন বলে দাবী চায়না গবেষকদের। চাইনিজ একাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস (CAAS) এর এই গবেষক দল OsDREB1C নামক পরিচিত জিনের একটি অতিরিক্ত অনুলিপি নিপ্পনবেয়ার নামক ধানের জাতে প্রবেশ করিয়ে এই ফলাফল পেয়েছেন বলে জানান। এই জেনেটিক পরিবর্তনটি ধান গাছকে আরও বেশি সার শোষণক্ষম করতে সাহায্য করে, এবং সালোকসংশ্লেষণ হারকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে এবং ফুল ফোটাকে ত্বরান্বিত করে। এই সবকটি বৈশিষ্টই প্রধান প্রধান দানাদার ফসলের ফলনে বিশেষ অবদান রাখে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এমনই চমকপ্রদ খবর প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সে গত ২৩ জুলাই ২০২২ তারিখে। তারা অন্য ধান গাছের এই সমজিনটি সরিয়ে দিয়ে জিনযুক্ত গাছে এর কার্যকারিতার তুলনামূলক প্রমাণ পেয়েছেন।

চাইনিজ একাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস CAAS-এর বিজ্ঞানী শাওবো ওয়েই এবং জিয়া লি-এর গ্রীনহাউজ পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, জিনবিহীন গাছগুলি জিন নিয়ন্ত্রণাধীন গাছের তুলনায় কম বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে OsDREB1C-এর অতিরিক্ত কপি যুক্ত করা হয়েছে সেগুলোর চারা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শিকড় দীর্ঘ হয়েছে। একাধিক জিনের প্রভাব সমন্বয়কারী এমন একটি একক জিন থেকে পূর্বের চেয়ে অধিক ফলন লাভ “সত্যিই অবাক করা ব্যাপার” বলেছেন রোথামস্টেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন উদ্ভিদ জেনেটিসিস্ট মি. ম্যাথিউ পল, যিনি এই কাজের সাথে জড়িত ছিলেন না। তার ভাষায়, আমি মনে করি না আগে আমরা এরকম সাফল্য দেখেছি। অন্যান্য ফসলেও এই পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা করা যেতে পারে বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।

একটি ফসলের ফলন অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ার ফল হচ্ছে- এর ফলন। কারণ, অনেক জিন উদ্ভিদের উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করতে কাজ করে। বছরের পর বছর ধরে, জীবপ্রযুক্তিবিদরা ফসলে একক জিন অনুসন্ধান করেছেন যা এককভাবে ফলন বাড়ানোর জন্য দায়ী। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তারা তাদের কৌতুহল এমন জিনগুলিতে স্থানান্তরিত করেছেন যা অন্যান্য জিনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং শারীরবিদ্যার ভাষায় তা একাধিক দিক যেমন- মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণ, সালোকসংশ্লেষণের গতি বৃদ্ধি এবং পাতা থেকে বীজে খাদ্যের পরিচলন বা সংস্থান নিয়ন্ত্রণ করে। ভুট্টার ক্ষেত্রে এই ধরনের একটি নিয়ন্ত্রক জিন পরিবর্তন করলে ১০% এর বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব- যা প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজনন পদ্ধতির দ্বারা প্রতি বছর মাত্র ১% হারে বৃদ্ধি করা সম্ভব। ফলে প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজনন পদ্ধতির তুলনায় এটি একটি বড় অর্জন বলে মনে করছেন তারা।

সম্ভাব্য ফলন বৃদ্ধিকারক জিন খুঁজে বের করার জন্য, চাইনিজ একাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস (CAAS) এর উদ্ভিদ জীববিজ্ঞানী ওয়েনবিন ঝো-এর নেতৃত্বে একটি দল ১১৮টি ধান এবং ভুট্টার নিয়ন্ত্রক জিনগুলি চিহ্ণিত করেছেন, যা ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর নামক প্রোটিনগুলিকে এনকোড করে। যা অন্যান্য গবেষকরা পূর্বে সালোকসংশ্লেষণে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ জিন হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। মি. ঝাউ-এর দল কম নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ মাটিতে জন্মানো ধানে কোনো জিন সক্রিয় হয় কিনা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন, কারণ এই ধরনের জিনগুলিই মাটি থেকে গাছের পুষ্টির গ্রহণের হারকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। দলটি ১৩টি জিন খুঁজে পেয়েছে যা কম নাইট্রোজেন-সমৃদ্ধ মাটিতে ধানের চারা জন্মানোর সময় তৈরি হয়; এবং এর মধ্যে পাঁচটি জিন নাইট্রোজেন গ্রহণের হারকে  চারগুণ বা তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। ভাল পুষ্টি গ্রহণের হার হওয়ার একটি কারণ হলো যে OsDREB1C-এর অতিরিক্ত কপিসহ গাছগুলি তাদের শিকড়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন গ্রহণ করে এবং এর বেশি অংশ অঙ্কুরে স্থানান্তরিত করে।

এভাবে রুপান্তরিত বা সংশোধিত উদ্ভিদগুলি সালোকসংশ্লেষণে আরও দক্ষ হয়; তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে যা উদ্ভিদ কোষের মধ্যে সালোকসংশ্লেষী উপাদান, তাদের পাতায় প্রায় ৩৮ ভাগ বেশি RuBisCO থাকে, যা সালোকসংশ্লেষণের একটি মূল এনজাইম। এই পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত উন্নত ধান গত ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে চীনের তিনটি স্থানে নাতিশীতোষ্ণ থেকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু অঞ্চলে উচ্চ ফলন দিয়েছে। বিশেষ করে, গবেষকরা জিনের একটি অতিরিক্ত অনুলিপি যোগ করে কৃষকদের রোপণ করা একটি উচ্চ-ফলনশীল ধানের জাতও রূপান্তরিত করেছেন। এই পরিবর্তিত আধুনিক ধান গাছগুলি নিয়ন্ত্রিত ধানের তুলনায় প্রতি প্লটে ৪০ভাগ বেশি ফলন দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা রিপোর্ট করেছেন। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি অব ডেভিসের ধানের জেনেটিসিস্ট মি. প্যাম রোনাল্ড বলেছেন ৪০ভাগ ফলন বৃদ্ধি একটি বড় অর্জন, এবং আশ্চর্যজনক ব্যাপারও বটে।

ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়, আরবান-চ্যাম্পেইনের একজন উদ্ভিদ শারীরত্ত্ববিদ মি. স্টিভ লং জানান, গ্রিনহাউজ পরীক্ষার ন্যায় মাঠেও এই রুপান্তরিত গাছগুলি বেশি ফলন দিয়েছে যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। গবেষকরা যা করেছে তা হল একটি খুব ভাল ধানের জাত তারা নির্বাচন করেছে। যে ফলাফল তারা পেয়েছেন তা প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজনন পদ্ধতির উন্নতির চেয়ে বৈচিত্র্যের দিক থেকে অনেক বেশি চমকপ্রদ এবং বিশ্বাসযোগ্য”।

এই পদ্ধতিতে রুপান্তরিত গাছগুলিতে তাড়াতাড়ি ফুল ফোটে, যা তাদের ছড়ায় শস্যদানা তৈরিতে আরও বেশি সময় পায়। পরিবেশের উপর নির্ভর করে দ্রুত ফুল ফোটানো ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকর জাত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ- এই জাত কৃষকদের প্রতি মৌসুমে আরও বেশি ফসল ফলাতে বা গ্রীষ্মের তাপ প্রখর হওয়ার আগে ফসল কাটা বা অন্যান্য সুবিধা দিতে পারে। যদিও পরিবর্তিত নিপ্পনবেয়ার ১৯ দিন আগে ফুল ফোটে যেখানে ব্যাপকভাবে চাষ করা অন্য জাতে মাত্র ২দিন আগে ধান ফুটেছে।

বৃহত্তর সম্ভাবনা প্রদর্শনের জন্য গবেষক দলটি গমের গবেষণা জাতের সাথে ধানের OsDREB1C জিন যুক্ত করে একই ধরনের প্রভাব খুঁজে পেয়েছে। OsDREB1C এবং অনুরূপ জিনগুলি কেবল ধান, গম এবং অন্যান্য ঘাস জাতীয় ফসলেই নয়, চওড়া পাতাযুক্ত অনেক উদ্ভিদেও রয়েছে। গবেষকরা অ্যারাবিডোপসিস নামক এক ধরনের সরিষা গাছে এমন জিনের একটি অতিরিক্ত অনুলিপি যোগ করে তুলনামূলক ভালো ফলাফল আবিষ্কার করেছেন। এটি উদ্ভিদ সাম্রাজ্যজুড়ে একটি সাধারণ প্রক্রিয়ার সাথে অতি সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা থেকে বুঝা যায় যে অন্যান্য একই ধরণের ফসল এই পরিবর্তন থেকে ফলন বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত হতে পারে।

মি. ঝো এবং তার টীমের উদ্ভাবিত ট্রান্সজেনিক ধানের জাত কিছু ভোক্তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু মি. ঝো এবং তাঁর সহকর্মীরা বলছেন যে, এই ফলন বৃদ্ধি উদ্ভিদের নিজস্ব জিন সম্পাদনা করে সম্পন্ন করা হলে সমস্যার কিছু দেখেন না তাঁরা যদি না তা অন্য উদ্ভিদ বা উৎস থেকে স্থানান্তর না করা হয়। এটিকে কিছু দেশে এখন ট্রান্সজেনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চেয়ে সহজভাবে দেখা হয়। আরেকটি সুবিধা হল যে ফসলের নাইট্রোজেন গ্রহণের হার ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ধানের জমিতে অতিরিক্ত সার ব্যবহারের পর তা অবচয়ের ফলে নদী এবং হ্রদের পানিতে মিশে যে দূষণ সৃষ্টি করে তাও হ্রাস করতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী মি. স্টিভেন কেলি বলেছেন, উন্নত সালোকসংশ্লেষণ দক্ষতার কারণে এই উদ্ভাবন বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। তিনি আরো বলেছেন, তারা যদি সঠিক ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর পেয়ে থাকেন তবে এটি বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বিশাল অর্জন বলে আমি মনে করি। আমি নিশ্চিত এ থেকে দারুন কিছু হবে। Source: https://www.science.org/content/article/supercharged-biotech-rice-yields-40-more-grain?

লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

This post has already been read 3060 times!

Check Also

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার আক্রমণ: ফলনের ক্ষতি ও করণীয়

ড. মো. মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে ধান প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিত এবং এর উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির …