রবিবার , নভেম্বর ১৭ ২০২৪

এন্টিবায়োটিক মুক্ত ডিম ও মুর‌গি উৎপাদ‌নে আশার আলো দেখাচ্ছে ব্যাকটেরিওফাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: নিরাপদ ডিম ও মাংসের প্রশ্নে ভোক্তা পর্যায়ে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে তা হলো- ’উৎপাদিত ডিম ও মাংস এন্টিবায়োটিক মুক্ত কী না। এ কথা অনস্বীকার্য মানুষের আয় ইনকাম বাড়ার সাথে সাথে দিনকে দিন খাদ্য সম্পর্কে প্রশ্ন ও সচেতনতাও বাড়ছে। মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে কোন খাবারটা তাদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর। সঙ্গত কারণে উৎপাাদক পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য তৈরির ক্ষেত্রে এক ধরনের চাপও তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাগণ এখন রপ্তানির কথা ভাবছেন; সরকারি ও বেসরকারি উভয় দিক থেকেই রপ্তানিকে বেশ জোর দেয়া হচ্ছে।  ফলে, দেশের বৃহৎ পোলট্রি উৎপাদক থেকে শুরু করে প্রান্তিক খামারিদের অনেকেই এন্টিবায়োটিক মুক্ত নিরাপদ পোলট্রি উৎপাদনের দিকে এখন মনোনিবেশ করছেন।

নিরাপদ এই পোলট্রি পণ্য (ডিম ও মুরগি) উৎপাদনে দেশের খামারিদের মাঝে আশার আলো দেখাচ্ছে ব্যাকটেরিওফাজ। বেশ কয়েকটি বড় বড় ব্রিডার ফার্ম থেকে শুরু করে মাঝারি ও ছোট পোলট্রি উদ্যোক্তাগণ এন্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে ব্যাকটেরিওফাজ ব্যবহারে সফলতা পেয়েছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পোলট্রি উৎপাদনে তাই তারা ব্যাকটেরিওফাজ -এর দিকে ঝুঁকছেন। তাঁদের মধ্যে দু’জনের বক্তব্য কেস স্টাডি আকারে এখানে দেয়া হলো-

কেস স্টাডি-১
দেশের পোলট্রি সেক্টরে সুপরিচিত কোম্পানি রাফিদ পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড। চুয়াডাঙ্গা জেলায় অবস্থিত কোম্পানিটিতে বর্তমানে ১৬ হাজার গ্র্যান্ট প্যারেন্ট স্টক ও ৩৫ হাজার ব্রিডার মুরগি (প্যারেন্ট স্টক) রয়েছে। উক্ত জিপি ও পিএস ফার্ম পরিচালনায় বর্তমানে কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন না বলে জানিয়েছেন, কোম্পানিটির সহকারি মহাব্যবস্থাপক জনাব শাহীন আলম।

এ সম্পর্কে জনাব শাহীন আলম এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের ফার্মের ফ্লকগুলোতে ই-কলাই ও সালমোনেলাজনিত সমস্যাগুলো থেকেই যাচ্ছিলো। সমাধান হিসেবে হয়তো আমরা কোন এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করছি ঠিকই কিন্তু দেখা গেলো সালমোনেলা থেকেই যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে কিছুদিনের মধ্যে আবার এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হচ্ছে। বেশ কয়েক মাস আগেও এসব সমস্যার মধ্যেই চলছিল আমাদের ব্রিডার ও জিপি (গ্র্যান্ড প্যারেন্ট) ফার্ম। ওই সময় হঠাৎ একদিন এভোন এনিমেল হেলথ -এর প্রতিনিধিগণ এন্টিবায়োটিকের বিকল্প ব্যাকটেরিওফাজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেন।

রাশিক জিপি হ্যাচারি লি. ও রাফিদ পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড এর সহকারি মহাব্যবস্থাপক জনাব শাহীন আলম।

তাঁরা জানান, বাফাসল+জি (BAFASAL+G)বাফাকল (BAFACOL) নামক দুটি ব্যাক্টোফেজ কোম্পানিটি বাজারজাত করছে যা উল্লেখিত সমস্যা সমাধানে ও এন্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে দারুন ফলদায়ক। তাদের কথা মতো, বাফাসল+জি (BAFASAL+G) নামক পণ্যটি প্রথমে আমরা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা শুরু করি এবং একটা সময় লক্ষ্য করি যে, সালমোনেলা নামক সমস্যাটি আর নেই। অতপর বাফাকল (BAFACOL) ব্যবহার করা শুরু করি এবং ই-কলাই প্রতিরোধে এটি দারুন কার্যকর বলে আমরা প্রমাণ পাই। এরপর থেকে উল্লেখিত পণ্য দুটো আমরা নিয়মিত ব্যবহার করে আসছি।

মি. শাহীন বলেন, একটি কথা মনে রাখতে হবে মুরগির গাট হেলথ বা অন্ত্রের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে তাহলে এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। বাফাসল+জি (BAFASAL+G)বাফাকল (BAFACOL) নামক পণ্য দুটো মুরগির গাট হেলথ সুস্থ রাখতে দারুনভাবে কার্যকর। এর ফলে আমরা একদিকে যেমন এন্টিবায়োটিক মুক্ত পোলট্রি উৎপাদন করতে পারছি, তেমনি এন্টিবায়োটিকের বাড়তি খরচ সাশ্রয় করতে পারছি। ‘ব্যাক্তিগতভাবে আমি নিজেও সালমোনেলা ও ই-কলাই প্রতিরোধে অন্যান্যদের যথাক্রমে বাফাসল+জি (BAFASAL+G)বাফাকল (BAFACOL) ব্যবহারের পরামর্শ দেই। কারণ, একটি ভালো উদ্যোগ ও জিনিসকে ভালো বলা ও উৎসাহিত করা আমাদের কর্তব্য’ যোগ করেন – মি. শাহীন?

কেস স্টাডি-২
পাবনা জেলার আটঘরিয়ায় অবস্থিত মাহী পোলট্রি ফার্ম। খামারের বয়স প্রায় ৩০ বছর। ফার্মটির সত্ত্বাধিকারী আলহাজ্ব মো. আবদুল বাতেন প্রায় তিন দশকের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন সালমোনেলা ও ই-কলাই মারাত্মক ধরনের জীবাণু। মাস ছয়েক আগেও উল্লেখিত সমস্যাগুলোর সমাধানে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতেন তিনি, কিন্তু এখন আর সেটি করেন না। কেন করেন না, আসুন তাহলে তার মুখ থেকেই জেনে নিই।

মো. আবদুল বাতেন এ্রগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, আমরা যতই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করি না কেন সালমোনেলা ও ই-কলাই সমস্যাগুলো থেকেই যায়। এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে সাময়িকভাবে হয়তো সেগুলোকে দমিয়ে রাখা যায় কিন্তু কিছুদিন পর আবার সেগুলো একটিভ হয়ে যায়। এন্টিবায়োটিকের একটি স্টেজ আছে এবং এটি ভালো-মন্দ দুই ধরনের ব্যাক্টেরিয়াকে ধ্বংস করে। আমি নিজেও এর বিকল্প কিছু পাওয়া যায় কি না, সেটি মনে মনে খুঁজছিলাম। এরই মাঝে একদিন এভোন এনিমেল হেলথ এর একজন বিক্রয় প্রতিনিধি এন্টিবায়োটিকের বিকল্প বাফাসল+জি (BAFASAL+G)বাফাকল (BAFACOL) সম্পর্কে আমাকে জানান। এভোন এনিমেল হেলথ এর বেশকিছু পণ্য আমি এর আগেও ব্যবহার করেছি এবং প্রায় সবগুলোতে ভালো রেজাল্ট পেয়েছি। ফলে, এক ধরনের বিশ্বাস ও আস্থা থেকেই উল্লেখিত ব্যাকটেরিওফাজ দুটো ব্যবহার করা শুরু করি এবং একটা সময় লক্ষ্য করি যে, আমার ফার্মে সালমোনেলা ও ই-কলাই নামক সমস্যাগুলো আর নেই।

‘বর্তমানে আমার ফার্মে প্রায় ৪ হাজার লেয়ার মুরগি রয়েছে। বাফাসল+জি (BAFASAL+G)বাফাকল (BAFACOL) ব্যবহারের পর থেকে আমি আর কোন এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করি না। শুধু তাই না, আমার দেখাদেখি আমার উপজেলার অনেকেই এখন উল্লেখিত পণ্য দুটো ব্যবহার করছেন। বাফাসল+জি (BAFASAL+G)বাফাকল (BAFACOL) করে আমাদের উৎপাদন খরচ যেমন সাশ্রয় হচ্ছে সেই সাথে বেড়েছে উৎপাদন। সার্বিকভাবে আমরা এখন সালমোনেলা ও ই-কলাই চিন্তামুক্ত’ -বলেন আলহাজ্ব  আব্দুল বাতেন।

এ সম্পর্কে টেকনিক্যাল ম্যানেজার ডা. বিকাশ চন্দ্র বিশ্বাস এগ্রিনিউজ কে বলেন, সারাবিশ্বেই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আতংকের নাম AMR বা এন্টি মাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স। আশির দশকের পর থেকেই সারাবিশ্বে নতুন কোন এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়নি। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণির দেহে দিনকে দিন এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। এমতাবস্থায় বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা এন্টিবায়োটিকের বিকল্প কিছু খুঁজছেন যেগলো ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়ার সাথে শক্তভাবে লড়াই করতে পারে।

তিনি বলেন, পোল্যান্ড ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ওষুধ কোম্পানী প্রোটিওন ফার্মাসিউটিক্যালস ৯০ দশকের শুরু থেকে প্রায় ১০-১২ বছর নিরলস গবেষণার পর এমন দুটি ব্যাকটেরিওফাজ খুঁজে পেয়েছেন যেগুলো কেবল টার্গেট স্পেসেফিক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করবে; এর বাইরে অন্য কোন ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে তারা লড়বে না। ব্যাকটেরিওফাজ হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত এক ধরনের ভাইরাস, যাকে আমরা ভালো ভাইরাস বলতে পারি। প্রোটিওন গবেষকগণ লক্ষ্য করলেন, খুঁজে পাওয়া ব্যাকটেরিওফাজ ‍দুটো সালমোনেলা ও ই-কলাই লড়াইয়ে দারুনভাবে সফল। উক্ত ব্যাকটেরিওফাজ দুটো দিয়েই প্রোটিওন ফার্মাসিউটিক্যালস বাফাসল+জি (BAFASAL+G)বাফাকল (BAFACOL) নামক দুটো পণ্য তৈরি যা যথাক্রমে সালমোনেলা ও ই-কলাই প্রতিরোধে কার্যকর।

ডা. বিকাশ বলেন, ব্যাকটেরিওফাজ আসলে কীভাবে কাজ করে আসুন সেটি এখন জানি। আমরা যখন কোন ব্যাকটেরিওফাজ মুরগি বা অন্য কোন প্রাণিকে দেবো, সেটি তখন খাদ্যনালীতে যাবে এবং টার্গেট স্পেসেফিক ব্যাকটেরিয়ার সাথে এটাচমেন্ট নিবে। পরবর্তীতে সেটি টার্গেট স্পেসেফিক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার ভেতরে ঢুকবে ও সংখ্যায় বাড়তে থাকে এবং একটা সময় সেটি পরিপূর্ণ হয়ে টার্গেটকৃত ব্যাকটেরিয়ার সেল ভেঙ্গে বের হয়ে আসবে এবং ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াটি তখন মারা যাবে। এভাবে ব্যাকটেরিওফাজটি খাদ্যনালীতে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করবে। যেহেতু এটি ন্যাচারাল, তাই এর কোন রেজিস্ট্যান্স হবে না’

ডা. বিকাশ আরো বলেন, এন্টিবায়োটিক প্রতিদিন দিতে হয় অন্যদিকে ব্যাকটেরিওফাজ দিতে হয় একদিন পর পর; সেক্ষেত্রে এটি খরচ সাশ্রয়ী। এন্টিবায়োটিক যেহেতু ভালো-মন্দ দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়াকেই ধ্বংস এবং অনেক ক্ষেত্রে রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে সেহেতু পোলট্রির উৎপাদন ও খরচের ওপর এর বিরুপ প্রভাব ফেলে।

তিনি আরো বলেন, পোলট্রি ডিম ও মাংসের ক্ষেত্রে ভোক্তা পর্যায়ে এন্টিবায়োটিকের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। আমাদের পোলট্রি সেক্টর যেহেতু স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির কথা চিন্তা করছে সেহেতু এন্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে ব্যাকটেরিওফাজ দেশীয় ভোক্তাদের যেমন আস্থা তৈরি করতে পারবে, রপ্তানিতে ইতিবাচক ভূমিকার রাখতে পারবে। মোট কথা, এন্টিবায়োটিক ফ্রি ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে বাফাসল+জি (BAFASAL+G)বাফাকল (BAFACOL) বিশেষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

‘উল্লেখিত ব্যাকটেরিওফাজ দুটোর একটি সীমাবদ্ধতা হলো- কমপক্ষে ৩ হাজার লেয়ার কিংবা ৫ হাজার ব্রয়লার মুরগির খামার ছাড়া উৎপাদন খরচে সাশ্রয়ী হবে না। তবে এটুকু আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি বাফাসল+জি (BAFASAL+G)বাফাকল (BAFACOL) ব্যবহারে আপনার পোলট্রি ফার্ম ৯৯% সালমোনেলা ও ই-কলাইমুক্ত থাকবে’ যোগ করেন ডা. বিকাশ।

This post has already been read 7385 times!

Check Also

ডিমের মূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

পাবনা সংবাদদাতা: ডিমের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা উল্লেখ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা …