ফারুক রহমান (সাতক্ষীরা সংবাদদাতা) : গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন সাতক্ষীরার কৃষকেরা। এই টমেটো চাষে কৃষকরা অসামান্য সফলতা পেয়েছেন। হেক্টর প্রতি ৩৫ টন পর্যন্ত এ টমেটো উৎপাদন করেছেন তারা। এ জেলার উৎপাদিত টমেটো স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক খুশি। উৎপাদন খরচ বাদে হেক্টরপ্রতি ৮-১০ লাখ টাকা লাভ হয়েছে বলে জানান চাষীরা। ফলে দিন দিন সাতক্ষীরায় গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ বাড়ছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মকালীন উচ্চ ফলনশীল বারি টমেটো চাষের জন্য সম্ভাবনাময় সাতক্ষীরা জেলা। বর্তমানে হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৫ টন পর্যন্ত হচ্ছে।
কলারোয়া উপজেলার কামারালি গ্রামের কৃষক আলাউদ্দিন গাজী জানান, তিনি লিজ নিয়ে আট বিঘা জমিতে চলতি মৌসুমের জন্য গ্রীষ্মকালীন বারি-১১ জাতের টমেটো চাষ করেছেন। বিঘাপ্রতি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ হয়েছে। সে হিসাবে চলতি মৌসুমে আট বিঘায় তার উৎপাদন খরচ ১২ লাখ টাকা। এবার গাছে যে পরিমাণ টমেটো ধরেছে তা ২০-২২ লাখ টাকা বিক্রি হবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ পরিমাণ টমেটো বিক্রি হয়েছে, যা ১০ লাখ টাকার বেশি।
তিনি জানান, এসব টমেটো হাটে বা বাজারে উঠানো লাগে না তার। উত্তরবঙ্গের নীলফামারী, গাইবান্ধা ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন পাইকাররা তার খেত থেকেই এসব টমেটো কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় চলতি মৌসুমে দাম ভালো পাওয়া যচ্ছে। গত মৌসুমে যে টমেটোর দাম পাওয়া গিয়েছে কেজিপ্রতি ৫০-৫৫ টাকা তার বর্তমান দাম পাওয়া যাচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা। দামের যদি হেরফের না হয় তাহলে আশা করা হচ্ছে চলতি মৌসুমে ১০-১২ লাখ টাকা লাভ হতে পারে।
কৃষক আলিম সরদার জানান, অন্য যেকোনো ফসলের তুলনায় অত্যন্ত ব্যয়বহুল গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ। যে কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক ঝুঁকি নিতে চান না। তারপরও এই গ্রামের অনেক কৃষক এ টমেটো চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।
তালা উপজেলার নগরঘাটা গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে দুই বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করেছেন। গত বছর একই পরিমাণ জমিতে ফসলটি চাষ করে ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি করেন। এতে তার ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। চলতি মৌসুমে খরচ একটু বেশি হবে। তিনি বলেন, বৃষ্টিপাত ঠিকমতো না হওয়ায় সেচ ও সার কীটনাশকের খরচ বেশি পড়ে গিয়েছে।
জেলা সদরের সুলতানপুর বড়বাজার কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান জানান, গ্রীষ্মকালীন টমেটোর বেশ চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি ভারতীয় টমেটো আমদানি বন্ধ থাকায় দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি কেজি গ্রীষ্মকালীন টমেটো ৮০-৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২২-২০২৩ মৌসুমে জেলায় ৭১২ দশমিক ৫০ বিঘা জমিতে উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন বারি টমেটো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ৬০ বিঘা, কলারোয়ায় ৫৫৫ বিঘা, তালায় ৭৫ বিঘা, কালিগঞ্জে ১৫ বিঘা, শ্যামগনর সাড়ে সাত বিঘা এবং আশাশুনিতে দুই বিঘা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ চাষ হচ্ছে কলারোয়া উপজেলায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বিনেরপোতা সাতক্ষীরার দায়িত্বরত বিজ্ঞানী ও প্রধান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. ওলি আহমেদ ফকির জানান, গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে খুবই সম্ভাবনাময় সাতক্ষীরা জেলা। জেলার মাটি ও আবহাওয়া এ জাতের টমেটো চাষে বেশ উপযোগী। এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। অন্যান্য সবজির তুলনায় এটি অত্যন্ত লাভজনক। ২০১০ সালের দিকে মূলত এই জেলায় গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ শুরু হয়।
তিনি বলেন, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন টমেটো বারি-৪, ৮, ১০ ও ১১ চাষ হচ্ছে সাতক্ষীরায়। এর মধ্যে বারি-৮ ও ১১ জাতের টমেটো বেশি পরিমাণে উৎপাদন হচ্ছে। তিনি বলেন, এ দুই প্রজাতির টমেটো আকারে যেমন বড় হয়, তেমনি ফলনও খুব বেশি। সাতক্ষীরায় হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৫ টন পর্যন্ত উৎপাদন হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দিন জানান, উচ্চ ফলনশীল গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ লাভজনক একটি ফসল। এর উৎপাদন খরচের পরিমাণও বেশি। হেক্টর প্রতি ১০-১১ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে। তারপরও কৃষকের হেক্টরে ৮/৯ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব।