ফয়জুল ইসলাম মানিক: ব্রয়লার মুরগি কি: মূলত ব্রয়লার শব্দটা মাংসের জন্য ব্যবহৃত পাখিকে বুঝানো হয়। কেউ কেউ ব্রয়লারকে পোল্ট্রি মুরগি বলে থাকে। আসলে পোল্ট্রি বলতে ১১টা প্রজাতির পাখি বা বার্ডকে বুঝানো হয় যেগুলো মানুষের অধীনে থেকে বংশবৃদ্ধি করিয়ে মাংস ও ডিম পাওয়া যায়। যেমন- মুরগি, হাঁস, কবুতর, কোয়েল, তিতির, উটপাখি, ময়ূর ইত্যাদি সবই হচ্ছে পোল্ট্রি।
অন্যদিকে, ব্রয়লার হচ্ছে যেকোন লিঙ্গের তরুণ বয়সী ৫ সপ্তাহের হাইব্রিড মুরগি যা দ্রুত বাড়ে, নরম স্মুথ টেক্সচারের মাংস উৎপন্ন করে এবং গড়ে ১.৬ কেজি খাবার খেয়ে ১ কেজি মাংস উৎপাদন করতে পারে। ব্রয়লার মুরগি তাদের ট্রেইট বা জেনেটিক বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী জেনারেশনে ট্রান্সফার করতে পারেনা অর্থাৎ বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা নেই।
ব্রয়লার মুরগি কিভাবে তৈরি হয়?
ব্রয়লার স্ট্রেইন তৈরি হয় ব্রয়লার প্যারেন্টস স্টক হতে। অর্থাৎ ব্রয়লারের বাবা মা’র মেটিং এর ফলে সৃষ্ট ডিম ফুটে ব্রয়লার বাচ্চা তৈরি হয়।
বিদেশের বিভিন্ন জাত হতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে কয়েক জেনারেশন পিউরক্লোজ ব্রিডিং করে এইগুলোকে ১ মাসে খাওয়ার উপযোগী করে এনেছে। অতীতে এই পিউর জাতগুলো ৪-৫ মাসে খাওয়ার উপযোগী হতো। বিজ্ঞানীরা এই জাতগুলোকে পিউর ব্রিডিং (ইনব্রিডিং) এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের লাইন বজায় রেখে গ্র্যান্ড প্যারেন্ট স্টক ( দাদা), প্যারেন্ট স্টক (বাবা) তৈরি করে এবং সর্বশেষ ৩য় জেনারেশনে (F2 হাইব্রিড) এসে প্যারেন্ট স্টক হতে ব্রয়লার পাই। বাজারে বর্তমানে বহুল প্রচলিত ব্রয়লার স্ট্রেইন Cobb 500 যেটা আমেরিকাতে ডেভেলপড করা হয় Bared Plymouth Rocks নামক জাত হতে। এই জাতগুলো ৪-৫ মাসে খাওয়ার উপযোগী হলেও এদের ৩য় জেনারেশন আমরা মাত্র ১ মাস বয়সে খেতে পারি বিজ্ঞানীদের কল্যাণে। এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে এই লিংকে ক্লিক করুন (https://zootecnicainternational.com/…/cobb-100-years…/)।
দেশি মুরগি ভালো না ব্রয়লার মুরগী ভালো?
দেশি মুরগি আর ব্রয়লার মুরগির পুষ্টিগত কোন পার্থক্য নেই; যেহেতু দুটোই মুরগি। তবে স্বাদের যে পার্থক্য আমরা টের পাই সেটা মূলত বয়সের কারণে। দেশি মুরগির মাংস শক্ত হয়; কারণ, এটা স্লো গ্রোয়িং, ৪-৫ মাসে মাংসটা পরিপক্ক হয়। সুতরাং, এর মাংস শক্ত হবেই। অন্যদিকে ব্রয়লার ১ মাসেই ২ কেজি হতে পারে যেটা দেশি মুরগি ২ বছরেও হয়না। সুতরাং দুটোর স্বাদে অবশ্যই পার্থক্য থাকবে কিন্তু এর মানে এই নয় যে দুটোর পুষ্টিমানে পার্থক্য আছে। তাছাড়া ব্রয়লারকে রেডিফিড খাওয়ানো হয় যেটা তার মাংসের স্বাদে প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে দেশি মুরগি স্ক্যাভেঞ্জিং করে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য খায় তাই তার মাংসের স্বাদ আর ব্রয়লারের স্বাদের পার্থক্য থাকবেই।
ব্রয়লার মুরগিতে কি হেভিমেটাল বা ক্রোমিয়াম বা অন্য কোন বিষাক্ত ধাতু পাওয়া যায়?
প্রথমত, কোন প্রাণীকে আপনি যা খাওয়াবেন সেটার প্রভাব তার মাংসে বা ডিমে পড়বে। দেশি মুরগি বা ব্রয়লার কোনটাতেই জন্মসূত্রে হেভিমেটাল বা ক্রোমিয়াম থাকেনা। এখন যদি তাদের খাদ্যে এইগুলো পাওয়া যায় তবে তা তাদের মাংসে এবং ডিমে যাবে। ক্রোমিয়াম কোন পুষ্টি উপাদান নয়, যা ব্রয়লার খাদ্যে যুক্ত করা হয়। মূলত ২০১৪ সালের দিকে ব্রয়লার খাদ্যে প্রোটিন সোর্স হিসেবে ট্যানারি বর্জ্য ব্যবহার করা হতো এবং সেটিও মোট ফিড উৎপাদনের খুবই সামান্য অংশ। ট্যানারি বর্জ্য বা বাই প্রোডাক্ট পোল্ট্রি খাদ্যের একটা ভালো প্রোটিনের উৎস। কিন্তু চামড়া ট্যানিং এর সময় এতে ক্রোমিয়াম সালফেট ব্যবহার করা হতো যার ফলে এই বাই প্রোডাক্টকে ক্রোমিয়াম চলে যেতো। যখন এই প্রোটিন খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করতো তখন তা খাদ্যে চলে আসতো এবং সর্বশেষ ব্রয়লারে চলে যেতো। কিন্তু ২০১৯ সালের দিকে সরকার পোল্ট্রি খাদ্যে ট্যানারি বর্জ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয়। তাই সেই সময় থেকেই কোম্পানিগুলো খাদ্যে সয়াবিন মিল, শুটকি মাছের গুড়া, সামুদ্রিক মাছের গুড়া ইত্যাদি বিকল্প প্রোটিন সোর্স ব্যবহার করে থাকেন। ট্যানারি বর্জ্য ব্যবহার করে কেউ তাদের কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি নষ্ট করতে চাইবেনা।
এরপরেও আপনাদের যদি এই ব্যাপারে সন্দেহ থাকে তাহলে আপনারা নিজেরাই বাজারে প্রচলিত পোল্ট্রির খাদ্য কিনে ল্যাবে টেস্ট করে ক্রোমিয়াম আছে কিনা দেখতে পারেন। তার রিপোর্ট যদি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে পাঠান তাহলে সেই কোম্পানির লাইসেন্স প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাতিল করে দেবে।
লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।