ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এর তান্ডবে খুলনায় ২০ কিলোমিটার নদীর বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রায় সম্পূর্ণ অংশ ধসে গেছে। আবার কোথাও ক্ষতি হয়েছে বেরিবাঁধের ঢাল। পূর্বে থেকেই দুর্বল বাঁধগুলো আরও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় ভেঙে নোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। এদিকে সিত্রাং আঘাত হানার আগের দিন (২৪ অক্টোবর) ভোরে খুলনার কয়রা উপজেলার সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা এলাকায় কপোতাক্ষ নদের প্রায় ৫০ মিটার বাঁধ ধসে যায়। ধসে যাওয়া বাঁধ এক বছর পূর্বে জাইকার অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়। বছর না ঘুরতেই ধসে যাওয়ায় কাজের মান নিয়ে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়োজিত শ্রমিকরা বেরিবাঁধটি মেরামত শুরু করেন এবং সিত্রাং’ এর তান্ডবে পূর্বেই মেরামত করা হয়। তবে পাশের বাঁধের জিও ব্যাগ তুলে ও মাটি কেটে ধসে যাওয়া স্থান মেরামত করায় ঝুঁকি বাড়ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুই পাশে মাটির দেয়াল ও মাঝখানে বালু ভরাট করে বাঁধটি গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নির্মাণ কাজ শেষ করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সে সময় নির্মাণকারীরা মূল বাঁধের পাশের নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলেছেন। পরে বাঁধের দুই পাশের ঢালে চরের মাটি দিয়ে বালু ঢেকে দেওয়া হয়। প্রতিনিয়িত ঢেউয়ের ধাক্কায় ধীরে ধীরে ঢালের মাটি সরে গিয়ে এখন মূল বাঁধে টান পড়েছে।
আরও জানা যায়, সেখানে প্রায় একশ’ শ্রমিক কোদাল দিয়ে মূল বাঁধের দু’পাশ থেকে মাটি কেটে বালু ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ সময় বাঁধের ঢাল থেকে জিও ব্যাগ তুলে নিতেও দেখা যায় শ্রমিকদের। গ্রামের আব্দুল খালেক বলেন, বাঁধের পাশের নদী থেকে বালু তুলে বাঁধ নির্মাণ করায় পানির চাপে সহজে ভেঙে গেছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কালাম শেখ বলেন, গেল বছর নির্মাণকালে সেনাবাহিনী কাজ করেছিল। তখন কপোতাক্ষ নদ থেকে বালি উত্তোলন করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। নদীর ঢেউ লেগে বাঁধের তলার মাটি সরে যাওয়ায় বালির রাস্তা ধসে গেছে। তিনি আরও বলেন, বাঁধটি পরিকল্পিতভাবে না করায় টেকসই হয়নি। নদীতে ড্যাম্পিং করে ও ব্লক ব্যবহার করলে রাস্তা নষ্ট হত না।
কয়রা সদর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির বলেন, হরিণখোলায় সেনাবাহিনীর তত্বাবধায়নে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। আমাদের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। দুই পাশে মাটি আর ভিতরে বালু দিয়ে ভরাট করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
পাউবো সূত্র জানায়, জাইকার অর্থায়নে তারা ঠিকাদারের মাধ্যমে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর ২ নম্বর কয়রা গ্রামের খালের গোড়া নামক স্থান থেকে গোবরা গ্রাম পর্যন্ত ৬০ মিটার ক্লোজার ও ১ হাজার ৬৪০ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। পাউবো’র অর্থায়নে ওমরর্স ট্রেডিং এ্যান্ড কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওই বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর নির্মাণ কাজ সম্পন্নের পর আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে তারা। নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ১০ কোটি টাকা।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, নদীশাসন ছাড়া শুধু বাঁধ নির্মাণ হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেটি আবারও নদীতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাঁধের পেছনে শত কোটি টাকা খরচের আগে নদী শাসন জরুরী। কিন্তু ওই অঞ্চলের পানি-মাটিতে বেড়ে ওঠা গ্রামের মানুষের কথাকে কখনো গুরুত্ব দেয়না পাউবো কর্মকর্তারা।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুল আলম বলেন, খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা এলাকার প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীর বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে দাকোপের খলিসা ও খনা নামক স্থান বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে মেরামতের কাজ চলছে।
খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায়। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, কয়রার হরিণখোলা, শাকবাড়িয়াসহ কিছু অংশ আংশিক ও কিছু অংশ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেনি।
তিনি আরও বলেন, হরিণখোলায় জাইকার অর্থায়নে বাঁধ নির্মাণের ডিজাইনে মাটি ছিল। বালি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। সেখানে মাটি দিয়েই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তিনি জানান, বর্তমানে মাটি সংকট থাকায় কিছু কিছু প্রকল্পে বালু দিয়ে বাঁধ তৈরির ডিজাইন করা হচ্ছে। বালুর ওপর দিয়ে এক মিটার মাটির লেয়ার দেয়া হচ্ছে। তবে ওখানকারটি নয়।
মূল বাঁধ কেটে ধসে যাওয়া স্থান মেরামত প্রসংগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জরুরী মূহুর্তে মাটি না পাওয়ায় এভাবে করা হচ্ছে। নদীর পানি কমলে চরের মাটি কেটে সব বাঁধ ঠিক করা হবে।
নির্মিত বাঁধ ধসে নষ্ট হওয়ার ঘটনা শুধু এটিই নয়। গত ১৭ জুলাই ভোরে কয়রার দক্ষিণ বেদকাশীর চরামুখা কপোতাক্ষ নদের বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটারের মতো ধসে যায়। বাপাউবো স‚ত্রে জানা যায়, ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে ওই এলাকার বাঁধ মেরামতে ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। কাজটিতে অর্থায়ন করে জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা (জাইকা)। কাজটির সার্বিক তদারকির দায়িত্বে রয়েছে বাপাউবো সাতক্ষীরা-২ বিভাগ। দরপত্রের মাধ্যমে ‘অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওই কাজটির দায়িত্ব পায়। গত ১৭ জুলাই চলমান কাজের চরমুখা অংশের প্রায় তিনশ’ মিটার ভেঙে নদীতে বিলিন হয়ে যায়।
খুলনার দাকোপ উপকুলের দুটি বাঁধ (৩২ ও ৩৩নং পোল্ডার) পুন:নির্মাণ হয়। অথচ কাজ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই আগস্ট মাসে দাকোপ উপজেলার ৩২ নম্বর পোল্ডারের একাধিক জায়গায় বাঁধ ধসে যায়। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ৫টি এলাকা। সর্বশেষ গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাজুয়া ইউনিয়নের চুনকুড়ি খেয়াঘাটের পাশে ১০০ মিটার বাঁধ (৩৩নং পোল্ডার) নদীতে ধসে যায়। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই কাজ শেষ হয় গত ৩০ জুন। বিশ্ব ব্যাংকে অর্থায়নে উপকুল রক্ষা বাঁধ প্রকল্পে খুলনার অংশে প্রকল্প ব্যয় ৩৫০ কোটি টাকা।