মু আ চিশতী : কৃষি প্রধান দেশ আমাদের বাংলাদেশ, আমাদের কৃষির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও আমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রধান পেশা কৃষি। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে কৃষিতে আমাদের সাফল্য অূতপূর্ব, বিশেষ করে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস সংগ্রামে আমরা ধান, সবজি, মাছ, আম উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম সারির দেশগুলোর মাঝে রয়েছি।
আমাদের কৃষির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে গরু ও মহিষ, উপমহাদেশের গরু ও মহিষ পালনের এক অণ্ন্য ইতিহাস রয়েছে, কৃষি কাজ, মাল টানা, জমি চাষ সহ গ্রামীন জিবনের এক অন্যতম অনুসংগ এই গরু ও মহিষ। আমদের দেশে বিগত ১০/১২ বছর ধরে গরু পালনে এক অবিস্মরণীয় পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে আমাদের পাশের দেশ ভারত থেকে আসা গরু মহিষ এর নিষেধাজ্ঞার পরে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠি গরু প্রতি পালনে অত্যন্ত মনো্যোগী হয়েছে, তাদের কল্যাণে এখানে প্রায় ১৩ লাখ খামার হয়েছে গরু, ছাগল, মহিষ, মুরগী ও মাছের, এই বিশাল পরিবর্তন দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পুরণে ভুমিকা রাখছে।
বিগত দুই বছরে গো-খাদ্যের দাম অত্যাধিক বেড়ে যাবার দরুন গরু পালন অত্যন্ত চালেঞ্জিং হয়ে দাড়িয়েছে, আমি বিগত কিছু বছর যাবত গরুর সাথে মহিষ পালনের উপোযগীতা নিয়ে কাজ করে কিছুটা কাজ করে সাফল্যের দেখা পেয়েছি, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আপনাদের সাথে কিছু কথা শেয়ার করছি।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় জলাভুমির মহিষ পালনের ইতিহাস অনেক বছরের, মনিপুরি সোয়াম্পি মহিষ নামে পরিচিত এই মহিষ পালন করা হয় দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশে, ভোলা, বরিশাল, সন্দীপ, নোয়াখালি, সুন্দরবন, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, কক্সবাজার, টেকনাফ, সিলেট এ এই জলাভুমির মহিষ পালন করা হয়। এরা অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ও চড়ে বেড়াতে পছন্দ করে, সারাদিনের মাঝে কিছুটা সময় জল কাদায় সময় কাটাতে বেশ পছন্দ করে মহিষ।
মহিষের প্রিয় খাবার জলা ঘাস ও নলখাগড়া, দানাদার খুব একটা পছন্দ করেনা, রোগ-বালাই খুব কম, বছরে একবার গলা ফুলা ভ্যাক্সিন ও দু’বার ক্রিমি করানো যথেষ্ট। মহিষ সংঘবদ্ধ পরিবার হিসেবে থাকাটা পছন্দ করে, দলে একজন নেতা গোছের থাকে, যার শাসনে বাকিরা চলে। মহিষ সাধারণত ২৬-৩০ মাস বয়সে গর্ভ ধারনের উপযোগী হয়, বাচ্চা দিতে প্রায় ৩১৫-৩৩৫ দিন সময় নেয়, এদের বাচ্চা গ্রহণ ও প্রসবের সাথে চাঁদের কিছুটা সম্পর্ক আছে বলে মুরুব্বীরা বলেন, বাচ্চার জন্মকালীন গড় ওজন হয় ৩৮-৪২ কেজি, বাঁছুর কে জন্মের পরে শাল দুধ পান করানো জরুরি। কিন্ত পরিমান মত অবশ্যই, মহিষের দুধে অধিক ফ্যাট থাকে বলে অতিরিক্ত দুধ পানে বাঁছুরের জিহবায় আলাদা লেয়ার পড়ে যায়, যা পরবর্তীতে নানা সমস্যা করতে পারে, বাঁছুর ছোট বয়সে মাটি চাটার চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে মিনারেল লবণ ভালো ফলাফল দেয়। মহিষের জন্য ভালো জাতের ষাঁর থাকলে প্রাকৃতিক প্রজনন সেরা; কিন্ত জাত উন্নয়ন এর জন্য কৃত্রিম প্রজনন এর সিদ্ধান্ত ভালো ফল আনতে পারে। আমাদের দেশে জলা মহিষের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে মুররাহ, নিলীরাভী ও জাফরাবাদী মহিষের প্রজনন উন্নয়ন কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে আমাদের জিটুজি উপায়ে মহিষ আমদানির অনুমতি রয়েছে। প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিএলআরআই) সম্প্রতি মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মুররাহ মহিষ এর সীমেন প্রান্তিক খামারিদের মাঝে বিস্তরনের উদ্যেগ নিয়েছে, যা আমাদের জন্য আশাবাদী এক খবর। সম্প্রতি আমার খামারে সরকারি মুররাহ সিমেনের দুটো বাচ্চা পেয়েছি, ও এডিএল এর একটি বাচ্চা পেয়েছি।
বেসরকারিভাবে এডিএল, লালতীর জাত উন্নয়ন ও সস্প্রসারণ নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে- লালতীর লাইভস্টক সার্ভিস দেশী মহিষে জিনোম সিকুয়েন্স করে এর গুনগত মান উন্নয়নে কাজ করছে।
মহিষ পালনে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়াতে পারলে অল্প খরচে অধিক দুধ ও মাংসের উৎপাদন করা সম্ভব ও বাইরে থেকে আসা ফ্রোজেন মহিষের মাংসের বাজারকে বন্ধ করে দেয়া সম্ভব। মহিষের মাংসে সাস্থ্যগত ঝুঁকি কম ও এর দুধে অধিক ফ্যাট থাকে যা উন্নত মানের দই ও সেরা মানের পনির করতে পারে; বিশেষ করে বরিশালের বইষা দধি এর সুনাম দেশ ছাড়িয়ে এখন দেশের বাইরেও ছড়িয়েছে। মহিষ পালনে খরচ অত্যন্ত কম বলে এটা এখনকার সময়ে অধিক মুল্যের গো খাদ্যের জন্য খামারিরা যেই হতাশায় আছেন, তা থেকে উত্তরনের উপায় হতে পারে। বিজ্ঞানভিত্তিক মহিষ খামার হতে পারে উন্নয়ন ও আয়ের এক নয়া দিগন্ত।
লেখক : প্রোপাইটর, রওশন আরা এগ্রো ও চিশতী এগ্রো ফুড, কমলগঞ্জ, মোওলভীবাজার।