রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪

পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সিরিয়াসলি সিরিয়াস হতে হবে -মসিউর রহমান

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: পোলট্রি ফার্মকে রোগ মুক্ত রাখতে এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করতে আমরা সাধারণত বায়োসিকিউরিটির কথা বলে থাকি। কিন্তু বায়োসিকিউরিটি বিষয়টিকে আমি অতটা সহজ মনে করি না, এটি অনেক ব্যাপক একটি বিষয়। তাই আমি ব্যাপক গভীরে না যেয়ে আজকে শুধু একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই এবং সেটি হলো Poultry Waste Management বা পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। আমরা সবাই বলি, আমরা Waste Management করি, কিন্তু সেটি আসলে সঠিকভাবে করি না। আমি গত ৬-৭ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমরা যদি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও সঠিকভাবে পদ্ধতিতে পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (Waste Management) করতে পারি, তবে জাস্ট এটির কারণেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। খামারের বর্জ্য বলতে পোলট্রি লিটার, হ্যাচারি বর্জ্য এবং মৃত মুরগিকে বুঝায় যেগুলোকে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক এবং সঠিক পদ্ধতিতে রিমুভ এবং রি-ইউজ করতে হবে। এগুলোকে কোনভাবেই বাইরে যেতে দেয়া যাবে না। বরং এগুলোকে ফার্মের ভেতরে রেখেই প্রক্রিয়াজাত করে বিদ্যুৎ ও জৈব সার উৎপাদন করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে গত ১২ বছর ধরে আমার ৬টি প্রজেক্ট চলছে। তাই, পোলট্রি বর্জ্যকে শুধুই বর্জ্য না, আমাদের সম্পদ মনে করতে হবে। আমি যদি আমাকে ডেভেলপ করতে চাই, তবে আমাদের নিজ উদ্যোগেই পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সিরিয়াসলি সিরিয়াস হতে হবে।

সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘DSM Mycotoxin Academy 2022’ শীর্ষক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এবং ওয়াপসা-বিবি সভাপতি ও প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান।

মসিউর রহমান বলেন, বর্তমান আমরা যেভাবে চলছি, আগামী ২০২৩ সন তারচেয়েও চ্যালেঞ্জিং বছর হবে। আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপ খুব চিন্তাভাবনা করে নিতে হবে। উৎপাদন খরচ কোথা থেকে কীভাবে কমানো যায় তার পরিকল্পনা করতে হবে। মুরগির বাচ্চা, মাংস, ডিম, ফিড যাই বলি না কেন আমরা এগুলোর দামের নিয়ন্ত্রক নই। চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে বাজার তার প্রয়োজনে এসবের দাম নির্ধারণ করে। সুতরাং আমাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম কীভাবে বাড়বে সেটি চিন্তা করার চেয়ে বরং উৎপাদন খরচ কীভাবে কমানো যাবে সেই বিষয়ে চিন্তা করা উচিত।

পোলট্রি শিল্পে নিজের শুরুর ইতিহাস সম্পর্কে দেশের অন্যতম সফল এই পোলট্রি শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, ফার্মিং শেখার জন্য ১৯৯২ সনে আমি পোলট্রি ফার্মিং শুরু করি এবং ১৯৯৩ সন থেকে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে করার উদ্যোগ নেই। সেই সময় আমার ফার্মে লেয়ার মুরগির সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার এবং ১৯৯৪ সনে ফিডমিল ও প্যারেন্ট স্টক শুরু করি। সেই সময় ৫ হাজার মুরগি কোন হ্যাচারিতে দিতে গেলে অগ্রিম টাকাসহ ৪-৫ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু এখন অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কেউ যদি চায়, আমাদের পক্ষ থেকে সপ্তাহে এখন ২ কোটি বাচ্চা সরবরাহ করা সম্ভব। জাস্ট চিন্তা করুন, আমাদের পোলট্রি সেক্টর আজকে কতটা গ্রোথ হয়েছে এবং এটিকে হয়তো আরো গ্রো করা যেতো যদি কোভিড ও বর্তমান অর্থনৈতিক খারাপ পরিস্থিতি না হতো। আমরা এখন একটি খুব ট্রাজেডি ও চ্যালেঞ্জিং একটি পরিস্থিতিতে আছি। এই ট্রাজেডি ও চ্যালেঞ্জিং জায়গাটি থেকে উত্তরণই হচ্ছে আমাদের সফলতা।

আমরা রেন্ডারিং প্লাণ্ট স্থাপনের মাধ্যমে আমাদের ফার্মের ডেড বার্ডগুলোকে (মৃত মুরগি) প্রক্রিয়াজাত করে পোলট্রি মিল হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। বর্তমানে এ ধরনের অনেক ছোট ছোট রেন্ডারিং মেশিন রয়েছে যেগুলো মৃত মুরগিকে ভালোভাবে কুক করে সালমোনেলা ও ই-কলাই মুক্ত পোলট্রি মিল উৎপাদন করতে পারে। আমরা চাইলে এসব মেশিন দেশে তৈরির উদ্যোগ নিতে পারি। এর ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যেমন সাশ্রয় হবে, সেই সাথে কমবে পোলট্রি উৎপাদন খরচ।

মসিউর রহমান বলেন, আমরা অনেকেই আমাদের ফার্মের পানি বাইরের খাল বা পুকুরে নির্গমন করে থাকি। কিন্তু সেটি কোনভাবেই করা উচিত না। আমরা কেন আমাদের পরিবেশ তথা দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবো? পোলট্রি ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে এসব পানিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে কাজে লাগাতে হবে। সবকিছু সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবে না; কারণ সরকারেরও কিছু নিয়ম কানুন ও আইনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এসব করতে পারলে ফার্মের ইনফেকশন লেভেল কতটা কমে যায় এবং এসব ব্যবস্থাপনার জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন তা এক বছরের মধ্যেই উঠে আসে।

তিনি বলেন, আমাদের একটি বিষয় সবসময়ই মাথায় রাখতে হবে, আমি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবো না তেমনি অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবো না। আমার কারণে কেন আশেপাশের পরিবেশ নষ্ট হবে, মানুষের অসুবিধা হবে সেটি গভীরভাবে ভাবতে হবে। পোলট্রি বর্জ্যের মৃত মুরগি থেকে শুরু করে পানি পর্যন্ত প্রতিটা নিয়ামককে আমাদের পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে এগুতে হবে।

মসিউর রহমান আরো বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে যেভাবে কমার্শিয়াল ফার্মিং বাড়ছে। একটা সময় একটি শেডে ৫-১০ হাজার মুরগির জায়গায় এখন ৫-১০ লাখ মুরগি পালন হচ্ছে। আমরা কি একটিবার চিন্তা করি, এসব ৫-১০ লাখ মুরগি থেকে কত টন বর্জ্য বের হচ্ছে? উদাহরণস্বরুপ, একটি লেয়ার মুরগি দিনে খাবার খায় প্রায় ১১৫ গ্রাম; এবার হিসেবে করুন লাখ লাখ মুরগি থেকে কি পরিমাণ ওয়েস্ট বা বর্জ্য আসতে পারে। আমরা যদি একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করি তখন এসব বর্জ্য আর বর্জ্য নয় বরং সম্পদে পরিণত হবে; আমাদের ফার্মের রোগবালাই কমে যাবে এবং সার্বিকভাবে উৎপাদন খরচ কমে যাবে। এসবের জন্য খুব বড় আকারের বিনিয়োগের দরকার হয় না।

“আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে মিট অ্যান্ড বোন মিল আমদানি বন্ধ রয়েছে। মৃত মুরগিকে প্রক্রিয়াজাত করে পোলট্রি মিল তৈরির মাধ্যমে আমরা এই মিট অ্যান্ড বোন মিলের অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারি। সাদা চোখে এটির পরিমাণ খুবই সামান্য হলেও বৃহৎ অর্থে এটির পরিমাণ ব্যাপক। কারণ, এর ফলে আমাদের পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে এবং ফার্মে ইনফেকশনের হার ব্যাপক কমে যাবে; ফলে ওষুধ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত খরচ বেঁচে যাবে। ব্যাথার ওষুধ খেলে ব্যাথা কমে যায় কিন্তু ব্যাথা কখনো চলে যায় না; তাই ব্যাথা দূর করতে হলে ব্যাথা যাতে না হয়, সেইভাবে আমাদের চলতে হবে” -যোগ করেন মসিউর রহমান।

বিপিআইসিসি সভাপতি বলেন, ব্যাক্তিগতভাবে সবাইকে বলি, পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা এবং পরামর্শ দেই কোথায় কি পাওয়া যায়। তাছাড়া প্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেট ঘাটলেই অনেক কিছু বের হয়ে যায়; এরপরও যদি কেউ আমার কাছে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা চায়, সেটি দিতে আমি প্রস্তুত। আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে- আমি শুধু একা শিখলেই হবে না, আমাদের পাশ্ববর্তী খামারিকেও শেখাতে হবে; তবেই আমি উপকৃত হবো, সবাই উপকৃত হবে এবং সার্বিকভাবে দেশ উপকৃত হবে।

This post has already been read 3985 times!

Check Also

সাড়ে ৬ টাকা দরে ভারতীয় ডিম এলো বাংলাদেশে!

এগ্রিনিউজ২৪.কম ডেস্ক: ডিম আমদানির অনুমতির পর চতুর্থ চালানে এবার ভারত থেকে ডিম আমদানি হলো সাড়ে …