বুধবার , ডিসেম্বর ২৫ ২০২৪

ধানের ঐতিহ্যে ফিরে আসুক দক্ষিণাঞ্চলের বালাম

কৃষিবিদ নাজমুন নাহার : ধানের দেশ বাংলাদেশ। আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও এদেশে রয়েছে হাজারো ধানের বৈচিত্র্য। ১৯৩০ সালের এক জরিপে জানা যায়, সে সময়ের অবিভক্ত বাংলায় প্রায় পনেরো হাজার স্থানীয় ধানের চাষ হতো। সেসবের মধ্যে অনেক ধানের নামই অজানা।

বর্তমানে দেশে উৎপাদিত প্রতিটি ধানেরই রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। এ জাতগুলোতে আছে খরা, জলাবদ্ধতা এবং লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা। এখন আর বর্ষা মৌসুমে আগের মতো পানিতে টইটুম্বুর থাকে না, ফলে দিনে দিনে বোনা আমন ধানের চাষাবাদ হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে কৃষক অধিক ফলনের আশায় উফশী ধানের চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রথম দিকে মাটি উর্বর থাকায় উফশী ধানের ফলন ভালো হয়। ফলে কৃষকরা স্থানীয় ধানের জাতগুলোর চাষাবাদ বন্ধ করে দেন। বর্তমানে জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে উফশী এবং হাইব্রিড ধানের বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। একদিকে খরা, অন্যদিকে ঢলের পানিতে বন্যা, সেইসাথে অধিক ঠান্ডায় উফশী ধান কিংবা হাইব্রিড ধান আবাদ করে কৃষকদের টিকে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় ধান চাষে ফলন অপেক্ষাকৃত কম। বাস্তবতার কারণেই আজ বিজ্ঞানী এবং নীতিনির্ধারকসহ সবাই বলছেন দেশীয় ধানের প্রাকৃতিক দুর্যোগসহনশীল বৈশিষ্ট্যগুলো উফশী এবং হাইব্রিড জাতের মাঝে আনতে পারলে কৃষকদের  জন্য সুবিধা হতো।

ধান, নদী, খাল এই তিনে বরিশাল। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসেছে প্রবাদটি। বর্তমানে বরিশাল অঞ্চলে নদী-খাল থাকলেও সেই ঐতিহ্যবাহী প্রসিদ্ধ চিকন বালাম চাল এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে নদীবিধৌত পলিসমৃদ্ধ জমিতে রোপা আমন মৌসুমে বালাম ধানের চাষ হতো।

‘বাংলাদেশের অভাব কী ভাই? বাংলাদেশের অভাব কী? বরিশালের বালাম চাল আর ঢাকার আছে গাওয়া ঘি।’’ বরিশালের ধান নিয়ে রচিত এই গানটি এখন আর শোনা যায় না। এক সময়ে ঐতিহ্যবাহী চিকন বালাম চালে বিখ্যাত ছিল বৃহত্তর বরিশাল। সুস্বাদু এই বালাম চালের ভাত খেয়ে তৃপ্ত হতেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।

বরিশাল থেকে হারিয়ে গেছে বালাম ধানের অস্তিত্ব। কম ফলন আর অধিক সময়ে উৎপাদিত বালাম ধানের জায়গায় দখল করে নিয়েছে স্বল্প সময়ে অধিকতর ফলনশীল উফশী ও হাইব্রিড জাতের ধান। বছরের তিন মৌসুমে হাইব্রিড জাতের ধানের অধিক ফলনে খুশি আর লাভবান হওয়ায় বালাম ধান আবাদে আগ্রহ নেই কৃষকদের।

কথিত আছে, বালাম চাল দেখে অবাক হয়েছিলেন চীনের পর্যটক হিউয়েনসাং। এছাড়াও বাংলার চালের ভূয়সী প্রশংসা করেন মরক্কোর পর্যটকই ইবনেবতুতা। সে সময়ে এলাকার কৃষকদের বালামি উপাধি দিয়েছিলেন খাদ্যরসিকরা। কিন্তু ২০/২৫ বছর আগের বালাম ধান-চালের অস্তিত্ব মিললেও  তা এখন বিলুপ্ত।

স্বাধীনতার পর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে খাদ্যের জোগান দিতে বাড়তি চালের উৎপাদন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ কারণে আস্তে আস্তে কমতে থাকে বরিশালের স্থানীয় বালাম ধান। বাড়তে থাকে উচ্চফলনশীল উফশী ও হাইব্রিড ধানের চাষ। এ কারণে এ অঞ্চলের মাঝারিউঁচু জমিতে আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী বালাম ধানের জায়গা দখল করে নেয়এসব উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন জাতের ধান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জেলায় বর্তমানে বালাম ধানের অল্প জমিতে বিআর-১৬ জাতের শাহী বালাম নামে আরেক ধানের চাষ করছে কৃষকরা। এর আগে একটা সময় বানারীপাড়া উপজেলার আউয়ার কালি বাজার, খোদা বকশ, চাখার, বাকপুর, ঝিরাকাঠি, চালতাবাড়ি, চাউলাকাঠি, কাজলাহার, ব্রাহ্মণকাঠি, ঝালকাঠি জেলার নদীবিধৌত অঞ্চলে বিভিন্ন গ্রামের ৯৫ ভাগ কৃষক ঐতিহ্যবাহী চিকন বালাম ধান চালের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।

আমন ধানের মৌসুম হচ্ছে- বাংলা মাস শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ণ। ইংরেজি মাস মধ্য জুলাই থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত ‘আমন মৌসুম’। আমন ধান সাধারণত নিচু জমিতে আবাদ করা হয়। পানি ছাড়া আমন ধান চাষ করা সম্ভব নয়। এ ধান আবাদ করার জন্য বীজতলায় ধানের চারা তৈরি করে মূল জমিতে রোপণ করা হয়। বরিশাল অঞ্চলে আমন মৌসুমে চাষ করা হয় সে সব ধানের মধ্যে লাল ভোজন, সাক্ষরখরা, ভূষিহারা, চাউলামানি, কাউয়াঠুটি, সাদামোটা, হলদেমোটা, মোতাধান, দুধসোনা, দুধকলম, চিনিগুড়া, মৌলতা, বাশফুলচিকন, যশোর বালাম, কাটারীভোগ, কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, মহোনভোগ, বড়চালানী, দিঘা, বাঁশফুল অন্যতম।

এই ধানের চাল অত্যন্ত উৎকৃষ্ট। সে সময় গোটা দক্ষিণাঞ্চলে চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদিত হতো এই ধান। চাষে খরচও ছিল কম। তাই চাষিরা বালাম ধান চাষে বেশ আগ্রহী ছিলেন।

বালাম চালের ভাত অত্যন্ত সুস্বাদু। স্বল্প মোটা অথবা সরু চালের ভাত খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন বরিশালের মানুষ। দেশের অন্যান্য স্থানেও এই চালের বেশ কদর ছিল। ধানের উৎপাদন ছিল প্রতি হেক্টর জমিতে চার টনের কাছাকাছি। কৃষকরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি ধান বিক্রি করতেন। কৃষকের এক মৌসুমে উৎপাদিত বালাম ধানে সারাবছর চলে যেত।

বালাম ধানের বিলুপ্তি সম্পর্কে সুনিদিষ্ট কারণ না জানা গেলেও অনেকের মতে, বালাম এখন অনেকটা দাদা-দাদিও কাছ থেকে শোনা গল্পের মতো। ধারণা করা হয়-কালের বিবর্তনে নগরায়ণ ও শিল্পোন্নয়নের ফলে বরিশাল থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

একসময় এ অঞ্চলে জনসংখ্যা ছিল কম। তখন যে পরিমাণ বালাম উৎপন্ন হতো, তা দিয়ে বরিশালের মানুষ সারা মাসের খাবার পেত। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ধান-চালের চাহিদাও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় অল্প জমিতে অধিকতর ফসল উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই উচ্চ ফলনশীল ধানের চাহিদা দেখা দেয়। সে অবস্থায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশি-বিদেশি উফশী ও হাইব্রিড ধান চাষের প্রতি মনোযোগী হয়। এর ফলে বরিশালসহ দেশের সব কৃষক ঐতিহ্য ভুলে নিজেদের অল্প জমিতে অধিক ফসল পেতে উফশী ও হাইব্রিড ধান চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এ কারণেই বালাম হারিয়ে গেছে বরিশাল থেকে। বালাম ধানগাছ আকারে বড় হওয়ায় বরিশালের কোনো কোনো এলাকার খাল কিংবা নদীর পাশে জোয়ার-ভাটার স্থলে এ ধানের চাষ করে থাকেন শৌখিন চাষিরা।

স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে খাদ্যের জোগান দিতে বাড়তি চালের উৎপাদন অনিবার্য হয়ে পরে। এ কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে দক্ষিণাঞ্চলের বালামসহ রোপা আমনের স্থানীয় জাতের ধান। বাড়তে থাকে উচ্চফলনশীল ধানের চাষ। এই কারণে এ অঞ্চলের মাঝারি উঁচু জমিতে আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী বালাম ধানের জায়গা দখল করে নেয় উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্রিধান।

একটি সূত্রমতে জানা গেছে, ১৯৭৪ সালে ভারত থেকে ভোজন ধানের বীজ আনা হয়েছিল। তখন দেশের উত্তরাঞ্চলে এ ধানের বীজে সাফল্য না এলেও দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকের মুখে হাসি ফোঁটে। অল্প জমিতে বীজ বপন করে অনেক বেশি ফলন ঘরে তোলেন কৃষকরা। ভোজন ধানের চাল অনেকটাই বালামের মতো দেখতে। যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো। ফলে বালামের স্থান দখল করে ভোজন দেশীয় বীজে পরিণত হয়। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে ভোজন ধানের বেশ  ভালোই চাষ হতো। পরবর্তী সময়ে ভোজন স্থান দখল করে নেয় দেশে উদ্ভাবিত ব্রি ধান৪৭।

বরিশালের স্থানীয় লোকজন বলেন, স্থানীয় মলঙ্গা বালাম চালে বিখ্যাত ছিল বরিশাল। কিন্তু দিনে দিনে কৃষকদের বালাম ধান চাষে আগ্রহ কমে যাওয়ায় এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী এই বালাম ধান এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তপ্রায় এই বালাম ধানসহ দেশিপ্রজাতি অন্যান্য জাতের ধানের আবাদ সম্প্রসারণের  উদ্যোগ নিতে হবে। বরিশালের ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় বালাম ধানের অস্তিত্ব পুনরায় ফিরে পেতে কৃষকের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক : কৃষিবিদ নাজমুন নাহার, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বরিশাল।

This post has already been read 4258 times!

Check Also

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার আক্রমণ: ফলনের ক্ষতি ও করণীয়

ড. মো. মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে ধান প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিত এবং এর উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির …