বৃহস্পতিবার , ডিসেম্বর ২৬ ২০২৪

টিএমআর: গবাদিপশুর খাদ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির শুভ সূচনা

. .বি.এম.খালেদুজ্জামান : কৃষি প্রধান বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, সুষম পুষ্টি, বেকার সমস্যার সমাধান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কৃষি জমির উর্বরতা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্মৃতিশক্তি বিকশিত মেধা সম্পন্ন জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য খাত হলো প্রাণিসম্পদ খাত। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিরলস প্রচেষ্টায় ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দুধ, মাংস ও ডিমের স্থিরকৃত চাহিদা ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে। দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগির টেকসই জাত উন্নয়ন এবং রোগ নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে উৎপাদন দ্বিগুণ করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপিতে স্থির মূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১.৯০% এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩.১০%। মোট কৃষিজ জিডিপি’তে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান  ১৬.৫২%। জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। বিগত ১২ বছরে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন বেড়েছে যথাক্রমে ৫.৫ গুণ, ৭ গুণ এবং ৪ গুণ। সর্বোপরি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি নিয়োগ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভ্যালু চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সহায়তার বৃদ্ধি, এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট  (SDG) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাংলাদেশে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন এবং গো-খাদ্যে নিত্য নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারনের মাধ্যমে দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ১২৫টি হলষ্টেইন ফ্রিজিয়ান ও জার্সি জাতের বকনা ও ষাঁড় আনয়নের মাধ্যমে গবাদিপশুতে যুগান্তকারী কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি প্রবর্তন ও ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের মাধ্যমে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বহুমাত্রিক কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে দেশী গবাদিপশুর উন্নয়ন ঘটেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সূচিত পথ ধরে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমানে আমরা মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি।

গবাদিপশু পালনে মোট খরচের শতকরা ৬৫-৭০ ভাগ খরচ হলো খাদ্য খরচ। দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে খামার মালিকদের দীর্ঘদিনের গো খাদ্যের সমস্যার কথা মাথায় রেখে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক “কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও ভ্রুণ স্থানান্তর প্রযুক্তি” প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে ১টি টোটাল মিক্সড রেশন (টিএমআর) প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে।

গবাদি পশুর খাদ্যে আঁশ জাতীয় এবং দানাদার খাদ্যের সুষম সংমিশ্রনকে টোটাল মিক্সড রেশন (টিএমআর) বলে যেখানে শতকরা ৫০ ভাগ অথবা তারও অধিক পরিমান রাফেজ বা আঁশ জাতীয় খাদ্য থাকে। রাফেজ গবাদি পশুর রুমেনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে। গবাদি পশুর রুমেন থাকার জন্যই গবাদি পশু ঘাস ও খড়ের মধ্যে বিদ্যমান জটিল ফাইবার ভেঙ্গে বিপাকীয় শক্তি সরবরাহ করে এবং আমাদের জন্য উন্নত পুষ্টিগুন সম্পন্ন দুধ ও মাংস তৈরি করতে পারে।

টিএমআর খাদ্যের সুবিধাদি

ক)   টিএমআর হলো গবাদি পশুর জন্য আঁশ জাতীয় এবং দানাদার খাদ্যের সংমিশ্রনে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ এক বিশেষ ধরণের সুষম গো-খাদ্য।

খ)   এতে গবাদি পশুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান সুষমভাবে সংমিশ্রিত থাকে।

গ)   স্থানীয় ভাবে প্রাপ্ত খাদ্য উপকরণ সমূহ টিএমআর খাদ্য প্ল্যান্ট বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়া জাত হয়ে সুপাচ্য খাদ্যে পরিণত হয়।

ঘ)   পরিপাচ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় টিএমআর উৎপাদিত খাদ্য ব্যবহারে কোন প্রকার খাদ্য উপকরণের অপচয় হয় না।

ঙ)   টিএমআর খাদ্য গবাদি পশুর আশানুরুপ দৈহিক বৃদ্ধিসহ সুস্বাস্থ্য রক্ষা করে।

চ)    এতে গবাদি পশুর প্রজনন স্বাস্থ্য সহ দুধ, মাংস এবং বাছুর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

ছ)   অল্প সংখ্যক শ্রম শক্তি কাজে লাগিয়ে অধিক পরিমানে খাদ্য উৎপাদন করা যায়।

জ)   টিএমআর খাদ্য প্রায় ৬ মাস ব্যাপী সংরক্ষণ করা যায়।

ঝ)   টিএমআর খাদ্যে কোন প্রকার রোগ-জীবাণু থাকে না।

ঞ)   টিএমআর খাদ্য বন্যা, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ কালীন সময়ে ৮-১০ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষনের মাধ্যমে ব্যবহার করা যায়।

উচ্চ প্রযুক্তির এই টিএমআর পশু খাদ্য প্ল্যান্ট উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের আরেকটি পালক সংযুক্ত হলো। প্রতি কেজি টিএমআর খাদ্যে অন্য যেকোন খাদ্য মিশ্রন খেকে ১০০-১৫০ কিলোক্যালরি বিপাকীয় শক্তি বেশি থাকে। তাছাড়া টিএমআর খাদ্যে শতকরা ২০-৩০ ভাগ পর্যন্ত খড় ব্যবহারের ফলে প্রতি কেজি টিএমআর খাদ্যে ৩.৫-৪.০ টাকা পর্যন্ত খাদ্য খরচ সাশ্রয় হবে এবং খড়ের পরিপাচ্যতা শতকরা ১০-১৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।

টিএমআর খাদ্য ব্যবস্থাপনা

টিএমআর খাদ্য আঁশ জাতীয় এবং দানাদার খাদ্য উপাদানের সুষম মিশ্রন যা থেকে গবাদিপশু তার প্রয়োজন অনুযায়ী বিপাকীয় শক্তি ও পরিপাচ্য আমিষ গ্রহণ করতে পারে। এ খাদ্যে চিটাগুড় ব্যবহারের ফলে পশুর শক্তির প্রাপ্যতা বেড়ে যায় এবং নন প্রোট্রিন নাইট্রোজেন এর মাধ্যমে পরিপাচ্য আমিষ বৃদ্ধি করা হয়। শতকরা ২০ ভাগ এবং ৩০ ভাগ খড় দ্ধারা টিএমআর ফিড ফরমুলেশন নিম্নে টেবিলে দেখানো হলো।

টিএমআর ফিড ফরমুলেশন

ক্রমিক নং খাদ্য উপদান ফিড ফরমুলেশন-১

(শতকরা ২০ ভাগ খড়)

ফিড ফরমুলেশন-২

(শতকরা ৩০ ভাগ খড়)

০১ খড় ২০ ৩০
০২ ভুট্টা (মোটা পাউডার) ২৫ ২২
০৩ গমের ভুষি ২৫ ২০
০৪ খেশারির ভুষি ০৫
০৫ মশুরী ভুষি ০৫ ০৫
০৬ সয়াবিন মিল ১৫ ১৬
০৭ ডিসিপি পাউডার ১.২৫ ১.২৫
০৮ চিটাগুড় ২.০০ ৪.০০
০৯ সোডিয়াম বাই কার্বোনেট ০.২০ ০.২০
১০ মোল্ড ইনহিবিটার ০.১০ ০.১০
১১ এমাইনো এসিডস ০.১০ ০.১০
১২ ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স ০.১০ ০.১০
১৩ ইউরিয়া ০.২৫ ০.২৫
১৪ লবণ ১.০০ ১.০০
  সর্বমোট ১০০.০০ ১০০.০০

টিএমআর ফিডে পুষ্টি উপাদান

ক্রমিক নং পুষ্টি উপাদান ফিড ফরমুলেশন-১

(শতকরা ২০ ভাগ খড়)

ফিড ফরমুলেশন -২

(শতকরা ৩০ভাগ খড়)

০১ মোট শুষ্ক পদার্থ (%) ৯০.৬৮ ৯০.৪৬
০২ বিপাকীয় শক্তি (কিলো ক্যালরি /কেজি) ২২৫০-২৩০০ ২১০০-২২২৫
০৩ ক্রড আমিষ (%) ১৯.৫০ ১৮.৭৫
০৪ পরিপাচ্য আমিষ (%) ১৪.০০ ১৩.৫০
০৫ প্রতিকেজি টিএমআর  উৎপাদন খরচ (শুধুমাত্র খাদ্য খরচ) টাকা ৩৭.৫০ ৩৬.০০

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪১ সালের স্মার্ট  বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে স্মার্ট প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের বিকল্প নেই। কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের উন্নত টিএমআর প্রযুক্তি বাস্তবায়নের ফলে গবাদিপশুর যেমন খাদ্য খরচ সাশ্রয় হবে ঠিক তেমনি দুধ ও মাংস উৎপাদনের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন তথা খামারী উদ্যেক্তা, দ্রারিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থান, পুষ্টি উন্নয়ন ও স্মার্ট প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় নতুন যুগের সূচনা হলো।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এই শুভ সূচনা সফল হোক।

লেখক: পরিচালক, কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার সাভার, ঢাকা।

This post has already been read 8493 times!

Check Also

বিএলআরআইতে ‘বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালা-২০২৪’ অনুষ্ঠানের সমাপনী অনুষ্ঠিত

নিজস্ব সংবাদদাতা: বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) কর্তৃক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সমাপ্ত গবেষণাসমূহের ফলাফল ও অগ্রগতি …