খোরশেদ আলম জুয়েল (ব্যাংকক থেকে ফিরে) : উৎপাদনশীল একটি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়- ১. গুণগত মান, এবং ২. উৎপাদন খরচ। এই দুটি বিষয়ের ব্যাত্যয় ঘটলে যে কোন উৎপাদনশীল ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কিংবা টেকসই করা মুশকিল। করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ডলার সংকট সামগ্রিক বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি এখন এক নিদারুন বাস্তবতা। প্রত্যেকটা ব্যবসার প্রত্যেকটা পণ্যের উৎপাদনকারীগণ এখন চেষ্টা করছেন- কীভাবে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা যায়।
ভাতে-মাছে বাঙালীর পাতে মাছ একটি অত্যাবশকীয় উপাদান। দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষ পূরণের অন্যতম উৎস মাছ। নানাবিধ কারণে প্রাকৃতিক মাছ কমতে থাকায় কয়েক দশক ধরে এদেশের মানুষ চাষের মাছের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ বাড়ার সাথে বাড়ছে মাছের চাহিদা, সেই সাথে বাড়ছে উৎপাদন। কিন্তু সেই উৎপাদন খরচের তুলনায় মাছের ন্যায্য দাম প্রাপ্তি চাষিদের জন্য সবসময় সুখকর নয়। কারণ, মাছ উৎপাদনের প্রধান খরচ খাদ্য (ফিড); বিগত এক বছরে এই খাদ্যের (ফিডের) দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ফিডের এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কাঁচামাল ও ডলারের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন ফিডমিলারগণ। সামগ্রিকভাবেই বছরখানেক ধরেই এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে প্রাণিজ আমিষ সেক্টরটিতে এবং সবার এখন নাম্বার ওয়ান টার্গেট কীভাবে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা যায়।
মাছের খাদ্য বা ফিড তৈরিতে ফিসমিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি এই একটি উপাদানের (ফিসমিল) মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সামান্যতম অবহেলায় শুধুমাত্র ফিডের মান-ই যে খারাপ হয় তা নয়; বরং একটি কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু পড়ে যেতে পারে চরম ঝুঁকিতে। কারণ একটি ভালো মানের বা বৈশিষ্টের ফিসমিল ছাড়ার কখনোই একটি ভালো মানের ফিড উৎপাদন সম্ভব নয়। ফিসমিল এবং অন্যান্য উপাদানের গুণগত মান ঠিক থাকলে ভালো মানের ফিড তৈরি হবে। এই ভালো মানের ফিড মাছের জন্য যেমন হবে সুস্বাদু, তেমনই হবে পুষ্টিকর।
যাইহোক, কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতিতে ফিড ও প্রাণিসম্পদ সেক্টর যখন টালমাটাল, ফিডের দাম ও উৎপাদন খরচ কমাতে সবাই যখন চিন্তিত, ঠিক এমনই এক সময় স্বস্তির খবর নিয়ে খুব অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এসেছে বাংলাদেশের বাজারে আসছে ব্রাজিলের বিশ্বখ্যাত গ্রুপো প্যাটেনসে (Groupo Patense) কোম্পানির ফিসমিল।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত VIV Asia 2023 অংশগ্রহণকারী কোম্পানি গ্রুপো প্যাটেনসে (Groupo Patense) এর বিক্রয় পরিচালক ডারিও কিতাজোনো ফ্রান্সা’র (Dario Kitazono Franca, Sales Director, Patense) সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। প্যাটেনসে সম্পর্কে জানতে চাইলে ডারিও কিতাজোনো ফ্রান্সা বলেন, গুণগত মানের কারণে বর্তমানে সারাবিশ্বে প্যাটেনসে উৎপাদিত ফিসমিল ও ফিসওয়েল ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বায়োমার্ক (BioMark), ন্যাশলে পিউরিনা (Nestlé Purina), স্ক্রেটিং (Skretting), ডি হিউস (De Heus) সহ বিশ্বের নামকরা সব ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পাটেনসে থেকে ফিসমিল সংগ্রহ করে। বিশ্বের ১৫০টিরও অধিক দেশে প্যাটেনসে পণ্য রপ্তানি হয়।
প্যাটেন্সে (Patense) উৎপাদিত টুনা, চিংড়ি ও স্যামন মাছ ছাড়াও সার্ডিন (Sardine) ফিসমিল ও ফিসওয়েলের আলাদা ধরনের কিছু বিশেষে বৈশিষ্ট রয়েছে বলে জানান ডারিও কিতাজোনো ফ্রান্সা (Dario Kitazono Franca)। তিনি বলেন, এগুলো উচ্চ প্রোটিন, ওমেগা ফ্যাটি এসিড সহ নানা গুণগতমানসম্পন্ন। তাঁর দাবী, তাদের উৎপাদিত সার্ডিন ফিসমিল ও ফিসওয়েলে এমন কিছু বাড়তি উপাদান ও বৈশিষ্ট রয়েছে যা প্রচলিত মার্কেটে অন্য কোনটিতেই নেই। বাড়তি এসব উপাদান ও বৈশিষ্ট শুধুমাত্র ফিডের মান-ই উন্নত করে না, সেই সাথে উৎপাদন খরচ কমাতেও দারুনভাবে কার্যকর।
প্যাটেনসে বিভিন্ন প্রোটিন লেভেলে ফিসমিল উৎপাদন করে এবং বিভিন্ন মার্কেট সেগমেন্টে রপ্তানি করে। কোম্পানিটির উৎপাদিত ফিসমিলে প্রোটিনের মাত্রা থাকে ৬০-৭০%। এছাড়াও এতে টিভিএন -এর পরিমাণ খুবই কম। এটি শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় সব উপাদান সমৃদ্ধই একটি ফিসমিল নয়; বরং এটির ঘ্রানও চমৎকার যা সহজেই মাছকে আকৃষ্ট করে – জানান মি. ডারিও।
ডারিও কিতাজোনো ফ্রান্সা (Dario Kitazono Franca) এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণত ৬০% প্রোটিন সমৃদ্ধ ফিসমিল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব ফিসমিলে যে শুধু প্রোটিন কম থাকে তা নয়, এর সাথে অ্যামাইনো এসিড ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানও কম থাকে। এর ফলে ফিড তৈরিতে এসব উপাদান বাড়তি করে যোগ করতে হয়; কিন্তু প্যাটেনসে উৎপাদিত ফিসমিলে যেহেতু প্রোটিন, অ্যামাইনো এসিড, ওমেগা ফ্যাটি এসিড থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে; সেহেতু ফিড তৈরিতে এগুলো আলাদা করে উল্লেখিত এডিটিভসগুলো যোগ করার প্রয়োজন হয় না। প্যাটেনসে ফিসমিলে ডিএল মিথিওনিন, লাইসিন ও অ্যামাইনো এসিডের পরিমান এতই বেশি থাকে যে, আলাদা করে এসব যোগ করার তেমন প্রয়োজন হয় না। উচ্চ প্রোটিন, মিথিওনিন, লাইসিন, ওমেগা-৩, ওমেগা-৬ ও অ্যামাইনো এসিডের কারণে ফিড উৎপাদনে ফিসমিলের পরিমাণও কম লাগে। ফলে সামগ্রিক ফিডের উৎপাদন খরচ কমাতে সহায়তা করে। অন্যদিকে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ থাকার কারণে মাছের ব্রেইন সুস্থ থাকে যা দৈহিক বৃদ্ধিতে ত্বরান্বিত করে।
মি. ডারিও আরো বলেন, অপেক্ষাকৃত টাটকা মাছ থেকে প্যাটেনসে ফিসমিল উৎপাদিত হয় বলে, এতে টিভিএন (Total Volatile Nitrogen) এর পরিমাণ খুবই কম থাকে। একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি যে, মাছ যত তাজা হবে সেখান থেকে উৎপাদিত ফিসমিলে টিভিএন এর পরিমাণ তত কম থাকবে। প্যাটেনসে এমন একটি কোম্পানি যাদের মাছ আহরণের জন্য নিজস্ব নৌবহর রয়েছে। যেহেতু আমাদের মাছ আহরণের নিজস্ব নৌ বহর রয়েছে, সেহেতু আমরা সাগর থেকে মাছ ধরার পর সেগুলো দ্রুত তাদের প্রোডাকশন প্লান্টে নিয়ে যাই। ফলে অপেক্ষাকৃত টাটকা মাছ থেকে কোয়ালিটিসম্পন্ন ফিসমিল উৎপাদন করা সম্ভব হয়। প্যাটেনসে মূলত আস্ত মাছ (Whole Fish) থেকে ফিসমিল উৎপাদন করে থাকে।
ডারিও কিতাজোনো ফ্রান্সা (Dario Kitazono Franca) দাবী করেন, ফিসমিলের ক্ষেত্রে টিভিএন স্ট্যান্ডার্ড লেভেল হচ্ছে ১২০ গ্রামের নিচে; সেখানে প্যাটেনসে উৎপাদিত ফিসমিলে টিভিএন এর পরিমাণ মাত্র ৩০-৫০ গ্রাম। স্বল্প উন্নত দেশগুলোতে ব্যবহৃত ফিসমিলে সাধারণত এত কম পরিমাণে টিভিএন দেখা যায় না। প্যাসেফিক ল্যাব ছাড়াও বিশ্বের আরো নামকরা সব ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট বলছে, আমাদের প্রোডাক্টের ডাইজেস্টিভ লেভেল হচ্ছে ৯১% এবং এটির অ্যামাইনো এসিড প্রোফাইল খুবই সমৃদ্ধ; অন্যান্য ফিসমিলের তুলনায় মিথিওনিন ও লাইসিন লেভেল খুবই উচ্চ মানের। যেহেতু ফিসমিলটি সার্ডিন মাছ থেকে উৎপাদন করা হয় সেহেতু এতে ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ এর পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। এর ফলে মাছের দৈহিক বৃদ্ধিতে ফিসমিলটি দারুনভাবে কার্যকর।
“আমরা যেটুকু জানতে পেরেছি ফিসওয়েলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কেবলমাত্র ফ্রি ফ্যাটি এসিড এবং আয়োডিন ভ্যালু পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু ফিসওয়েলের আসল গুণগত মান চেক করার জন্য ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ পরীক্ষা করে দেখতে হবে; দেখতে হবে এতে ইপিএ এবং ডিএইচএ কতটুকু আছে; মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশে এটি নাকি কেউ পরীক্ষা করে দেখে না। ফিসমিলের কোয়ালিটি বিবেচনায় এই পরীক্ষাটি করা অত্যন্ত জরুরি। প্যাটেনসে উৎপাদিত সার্ডিন ফিসওয়েলে ২৮% ইপিএ এবং ডিএইচএ আছে এবং এটি বিশ্বের নামকরা সব ল্যাব দ্বারা স্বীকৃত। এই ফিসওয়েল ব্যবহার করলে ফিডে বাড়তি এডিটিভস এর প্রয়োজন হবে না” -যোগ করেন মি. ডারিও।
গ্রুপো প্যাটেনসে (Groupo Patense) ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্যাটেন্সে উৎপাদিত সার্ডিন মিল (Sardine Meal), সার্ডিন ওয়েল (Sardine Oil), স্যামন মিল (Salmon Meal), স্যামন ওয়েল (Salmon Oil), শ্রিম্প মিল (Shrimp Meal), টুনা মিল (Tuna Meal) ও ফিস ওয়েল (Fish Oil) মূলত নন-রুমিন্যান্ট প্রাণির (পোলট্রি, মৎস্য ও পোষা প্রাণী) সুষম খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
পাটেনসে ব্রাজিলের অন্যতম বৃহৎ রেন্ডারিং কোম্পানি। ব্রাজিলের বিভিন্ন প্রদেশে তাদের ২০টির মতো প্লান্ট আছে। এর মধ্যে সর্বমোট ৫টি ফিসমিল প্লাণ্ট আছে। তারা স্পেশালাইজড ফিসমিল উৎপাদন ছাড়াও মাছের বিভিন্ন ধরনের ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য উৎপাদন করে। এদের মধ্যে টুনা ফিসমিল, স্যামন ফিসমিল ও ফিস ওয়েল, সার্ডিন ফিসমিল ও ফিস ওয়েল, শ্রিম্প মিল উল্লেখযোগ্য। ল্যাটিন আমেরিকা, চিলি, পেরু, নরওয়েসহ বিশ্বের দামী মাছের জন্য ফিস ফিড উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোতে রপ্তানি করে। প্যারানাগুয়া বন্দরের বৃহত্তম রপ্তানিকারকদের মধ্যে প্যাটেন্সে বর্তমানে একটি।