রবিবার , নভেম্বর ১৭ ২০২৪

হাঁস নিয়ে ঢাকা গ্রুপের সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা

বিশ্ব অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার জন্য যে কোন একটা চাকরী পাওয়াটাই যেন যুবকদের জন্য আজ সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ফলশ্রুতিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে জনসাধরণের মাঝে খাদ্য পণ্যের দাম নিয়ে দিন দিন অসন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দামের নাজেহাল অবস্থার জন্য মানুষ আজ দিশেহারা এবং ক্লান্ত । এক বেলা খাবার যোগানোর জন্য মানুষ যে কোন কষ্ট করতে প্রস্তুত। পরিবারের সদস্যদের মুখে একটু খাবার তুলে ধরার জন্য মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছে। একদিকে সমাজের কিছু মানুষের রক্তচক্ষু চাহনি এবং বেকারত্বের অভিশপ্ত জীবন থেকে বাচার জন্য শিক্ষিত যুবকরা আজ দেশ ছাড়ছে। সঠিক দিক নির্দেশনা না থাকার কারণে বেকারত্বের অভিশপ্ত জীবন থেকে মানুষ আজ বাহির হতে পারছে না।

তাই দেশের এই বিশাল জনসংখ্যাকে উদ্যেক্তা হিসেবে গড়ে তুলার জন্য ঢাকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক  প্রাণিসম্পদ খাতে বিশেষ নজর দিয়েছেন। তিনি উপলব্দি করেছেন সুষম পুষ্টি, বেকার সমস্যার সমাধান, আত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনের জন্য প্রাণিসম্পদ খাত হলো  অপরিহার্য । দেশের প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৭০-৭৫%  আমিষ এ প্রাণিসম্পদ খাত থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। ডিম, দুধ, মাছ, মাংস খাওয়ার পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়লেও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন এখনও সম্ভব হয়নি। প্রোটিন বিষয়ে সাধারন মানুষের ভুল ধারণা, অপপ্রচার ও সচেতনতার অভাব এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। প্রোটিন ঘাটতির কারণে দেখা দিচ্ছে নানাবিধ রোগব্যাধি ।

প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য ঢাকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক  চিন্তা করলেন হাঁস হতে পারে আমাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের সম্ভাবনাময় একটা খাত। হাঁস পালন করে  অনেক বেকার যুবক-যুবতী সহজে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে। রোগ বালাইয়ের ঝুঁকি কম থাকার পাশাপাশি খাদ্য খরচ কম বলে এ খাতটিকে সম্ভাবনাময় বলে মনে করছেন তিনি।

একটা সময় ছিল হাঁস পালন করত শুধু চলনবিলের আশেপাশের লোকেরা এবং কিছু গ্রামের মহিলা।  গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্রও পাল্টে দিয়েছে হাঁস,  গ্রামের তরুণেরা তো বটেই, গৃহিণীরাও যুক্ত হয়েছে হাঁস পালনে। অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে খাবার খরচই অনেক লাগে অথচ হাঁসের ক্ষেত্রে উল্টো। অন্যান্য প্রাণীর চাইতে হাঁসের ব্যবস্থাপনা খুব সহজ। কারণ হাঁস একেবারে প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকে, মাছ, ঝিনুক, শামুক, পোকামাকড়, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি হলো হাঁসের প্রধান খাদ্য। অন্তত ত্রিশ ভাগ খাবার তারা এসব জায়গা থেকে পায় । আবার পুকুরে হাঁস চাষ করলে সার ও মাছের খাদ্য ছাড়াই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব।

একটা সময় আমাদের দেশে মানুষের ভুল ধারণা ছিল হাঁসের মাংস ও ডিম শুধু শীতকালীন খাবার। কিন্তু মানুষ এখন প্রাণিজ প্রোটিনের উপর অনেক সচেতন। ভোক্তা পর্যায়ে হাঁসের মাংসের চাহিদা বাড়ার কারণে শুধু শীতকালিন সময়ে না সারা বছর হাঁসের মাংস বিক্রি হচ্ছে দেশের জেলা শহরের বিভিন্ন সুপার শপে এবং বাজারে। তাছাড়া গ্রামগঞ্জে এবং শহরে গড়ে উঠছে হাঁসের মাংসের স্বতন্ত্র রেস্টুরেন্ট। আগে শুধু দেশী হাঁস ছিল যা বছরে ৪০-৫০ টি ডিম দিতে পারতো। কিন্তু এখন অনেক জাত আছে যেগুলো থেকে বছরে তিনশ’র বেশি ডিম পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ভোক্তা পর্যায়ে হাঁসের মাংস ও ডিমের অধিক চাহিদার কারণে মানুষ এখন আর ইনব্রিড জাতীয় দেশি হাঁস গুলো লালন পালন করে না। কারণ দেশী ইনব্রিড জাতীয় হাঁসগুলো বাণিজ্যিক ভাবে লাভজনক না। ফলে অধিক রোগব্যাধির কারণে তাদের থেকে কাঙ্ক্ষিত ডিম ও মাংস পাওয়া যায় না।

হাঁসের অরিজিনাল ব্রিড বা মূল জাতটি দিতে পারে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত ডিম ও মাংস। দেশের হাজারো তরুণ ও বেকারদের কথা চিন্তা করে ঢাকা গ্রুপ আমদানি করতে যাচ্ছে ফ্রান্সের বিখ্যাত অরবিয়া কোম্পানি থেকে ১ দিন বয়সের হাঁসের প্যারেন্ট স্টক বাচ্ছা । সেই লক্ষ্যে ঢাকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ এবং মহাব্যবস্থাপক ডা. শাহাদত হোসেন হাঁসের দেশ হিসেবে পরিচিত তাইওয়ান এবং ফ্রান্সের বিভিন্ন হাঁসের খামার পরিদর্শন করেন। তাইওয়ান এবং ফ্রান্সের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঢাকা গ্রুপ গড়ে তুলবে অত্যাধুনিক  এক প্যারেন্ট স্টক ফার্ম। তাদের এই প্যারেন্ট স্টক হতে উৎপাদিত ১ দিন বয়সী উন্নতমানের ‘পেকিন’ জাতের হাঁসের বাচ্চা বাজারজাত করবে ঢাকা গ্রুপ। যা দেশের প্রাণিজ খাতে ডিম ও মাংসের ঘাটতি পূরণে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, এবং খামারিদের দুঃখের গ্লানি দূর করে মুখে হাসি ফুটাবে। কারণ সাধারণ শেডে বাঁশ, কাঠ বা নেটের পাটাতনের ওপর মুরগির মতোই পালন করা যাবে এই হাঁস। ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে এই হাঁস ডিম ও মাংস দিতে সক্ষম।

বৈজ্ঞানিক উপায়ে হাঁস থাকার জন্য বাসস্থান একটু উঁচু জায়গায় করতে হবে, এই হাঁস পালনের জন্য বড় জলাশয়ের প্রয়োজন হয় না। এই হাঁস সম্পূর্ণ ছেড়ে কিংবা আংশিক ছেড়ে বা সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় পালন করা যেতে পারে। অন্যান্য হাঁসের তুলনায় এই হাঁসের রোগব্যাধি কম বলে মারা যাওয়ার সংখ্যা ও খুব কম হয় ফলে সঠিক সময়ে সঠিক ওজন পাওয়া যায়। ফ্রান্স থেকে আমদানিকৃত এই প্যারেন্ট স্টক হতে উৎপাদিত ১ দিন বয়সী হাঁসের বাচ্চা ঘিরে তৈরি হতে পারে নতুন বাজার, যা টেকসই করবে আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে। ইতিমধ্যে ৪৮ হাজার প্যারেন্ট স্টক বাচ্চার ৩ মাস অন্তর অন্তর প্রি অর্ডার বুকড করা হয়েছে।

আমাদের লক্ষ্য হলো প্রতি সপ্তাহে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করা। এই শিল্প শুধু প্রোটিন চাহিদাই পূরণ করবে না বরং হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং বেকারত্ম দূরীকরনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: কৃষিবিদ মো. নাজমুল হাসান, ব্যবস্থাপক, ঢাকা ব্রিডার্স এন্ড হ্যাচারী লিমিটেড; সাবেক শিক্ষার্থী, পশুপালন অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

This post has already been read 4568 times!

Check Also

ডিমের মূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

পাবনা সংবাদদাতা: ডিমের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা উল্লেখ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা …