ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : তরমুজের সময় নয় এখন তবুও গাছে গাছে ঝুলছে তরমুজ! দেখতে ছোটও নয়, প্রতিটি ওজন হবে ৫-৮ কেজি। তরমুজের মৌসুম না থাকলেও অসময়ে তরমুজ চাষ হচ্ছে উপকুলের লবণাক্ত এলাকা খুলনায়। অফ সিজনের তরমুজ চাষ করে কৃষকরা পেয়েছে ব্যাপক সফলতা। ফলে অফ সিজনের তরমুজ চাষ করে কৃষকের মুখে ফুটসে হাসির ফোয়ারা।
সরেজমিন দেখা গেছে,মাছের ঘেরের আইলের ধার দিয়ে বানানো হয়েছে মাচা। বাঁশ ও নাইলনের সূতা দিয়ে তৈরি সেই মাচাতে ঝুলছে অসংখ্য তরমুজ। ভারে যেন ছিঁড়ে পড়তে না পারে সেজন্য নেটের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে প্রতিটি তরমুজ। পানির ওপর সবুজ ডগায় ঝুলে থাকা রসালো তরমুজ দেখে যে কারোর-ই মন ভরে যাবে। রসালো প্রতিটি তরমুজের ওজন ৫ থেকে ৮ কেজি। ঘেরের পাশে মাচা পদ্ধতিতে তরমুজ চাষের এ দৃশ্য এখন খুলনাঞ্চলে বেশ পরিচিত। খুলনা জেলার ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউনিয়ন, বরাতিয়া, মাগুরখালি ইউনিয়ন, বটিয়াঘাটা উপজলার গংগারামপুর ইউনিয়ন ও বাগেরহাট সদর মোল্লাহাট ও পাশ্ববর্তী গোপালগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে এ অফসিজন তরমুজ চাষ হচ্ছে।
লবণাক্ত মাটিতে অসময়ের বর্ষাকালীন এ তরমুজ চাষে বাম্পার ফলন পেয়ে খুশি কৃষকরা। কৃষকরা জানান, প্রতি কেজি তরমুজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৫০- ৬০ টাকায়। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০/৮০ টাকায়। ফলে কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসির ফোয়ারা।
জিকেবিএসপি প্রকল্পের আওতায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষি ভিক্তিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষে মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের মাটি ও সার ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিকেবিএসপির প্রকল্পের মাধ্যমে ২০ বিঘা ঘেরের পাড়ে অফসিজন তরমুজ চাষ হচ্ছে। অফসিজন তরমুজ জাতগুলো হচ্ছে এশিয়ান ২, সুইট ড্রাগন, ড্র্রাগন কিং জাতের তরমুজ চাষে ব্যাপক সাফল্য পাচ্ছে কৃষকরা। এর ফলে কৃষক পরিবারে যোগ হচ্ছে বাড়তি আয়ও। অফসিজন তরমুজ চাষ লাভজনক হওয়ার কারণে উপকুলীয় লবণাক্ত এলাকায় দিন দিন এশিয়ান ২, সুইট ড্রাগন, ড্র্রাগন কিং জাতের তরমুজ চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের মাঝে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, গত ১ জুন বর্ষাকালীন তরমুজের বীজ বপন করা হয়। যা ১৩ আগস্ট থেকে কাটা শুরু করেছেন তারা। প্রথম পর্যায়ে তরমুজ কাটা শেষ হলে তারা দ্বিতীয়বার বীজ বপন করবেন। শীত পড়লে আবার তরমুজ কাটা হবে।
গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা -পিরোজপুর জিকেবিএসপি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানব সম্পাদে পরিনত করা হয়েছে। প্রশিক্ষনলদ্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সঠিক নিয়মে চাষাবাদ করলে দ্বিগুন ফসল উৎপাদন হবে। কৃষকদের বিনামূলে সার, বীজ প্রশিক্ষণসহ সকল প্রকার উপকরণ কুষকদের মাঝে বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়েছে । তিনি আরো বলেন, এর আগে হাইব্রিড নাম্বার ওয়ান ও টপ সুইট নামের তরমুজের দুটি জাত চাষ করা হয়েছে। সম্প্রতি আমরা অফসিজন তরমুজের এশিয়ান ২, সুইট ড্রাগন, ড্র্রাগন কিং জাতের তরমুজ চাষে কৃষকদে সার্বিক সহায়তা দিয়ে আসছি । তারই ধারাবাহিকতায় ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউনিয়ন, বরাতিয়া, মাগুরখালি ইউনিয়ন, বটিয়াঘাটা উপজলার গংগারামপুর ইউনিয়নের ২০ বিঘা ঘেরের পাড়ে অফসিজন তরমুজ চাষ করে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে ।
তিনি আরো জানান,ঘেরের পাড়ে তরমুজ চাষ করায় বর্ষাকালে সেচের প্রয়োজন হয় না। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পাওয়া যায়। এতে করে কৃষকরা আইপিএম (ওষুধ ব্যবহার না করে) পদ্ধতিতে ফসল আবাদ করছেন। ফলে পোকা মাকড়ের আক্রমণও কম হচ্ছে। তিনি আরও জানান, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় বর্ষাকালীন তরমুজ, শিম, টমোটো, হলুদ, মানকচু, লাউ, মিষ্টি কুমড়া ও ধানের ওপর গবেষণা চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষিতে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
জানাগেছে.দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আড়াই লক্ষাধিক মাছের ঘেরের আইলে অসময়ে এ তরমুজ চাষ সম্প্রসারিত করা গেলে এ অঞ্চলের কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও পর্যায়ক্রমে প্রযুক্তিটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া গেলে বাড়তি আয়ে লাভবান হবে কৃষকরা। ঘেরে নিচে মাছ চাষ হলেও পাড় থেকে ৮-১০ হাত পর্যন্ত পানির ওপরে মাচা করে এ তরমুজ চাষ হচ্ছে। আর বাঁশ ও নাইলন সুতো দিয়ে তৈরি মাচাতে ঝুলছে অসংখ্য তরমুজ। আর নিচে পানিতে ঘুরে বেড়ায় মাছ। খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আড়াই লক্ষাধিক চিংড়ি ঘেরের পতিত আইলে তরমুজ চাষ সম্প্রসারিত করা গেলে কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
জানা গেছে, আশির দশক থেকে খুলনাঞ্চলে ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু‘ চিংড়ি ঘেরগুলোর বেড়ি বাঁধ পতিত পড়ে থাকত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘেরের বেড়ি বাঁধ বা আইলে ব্যাপকহারে সবজি চাষ শুরু হয়। প্রচলিত সবজি চাষের পাশাপাশি বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ার কয়েকজন কৃষক ‘অফসিজনে’তরমুজ চাষ শুরু করে। এই চাষে খরচও যেমন কম, তেমনি বাজারে মূল্যও বেশি পাওয়ায় কৃষকরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, আমাদের মাটি ব্যবস্থাপনা সার ও পানি ব্যবস্থাপনা কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছি । নতুন এই প্রযুক্তিতে প্রাথমিকভাবেই সফল হওয়া গেছে। লবণাক্ত এলাকায় সর্বত্র এটি ছড়িয়ে দেয়া হবে কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে যাতে কৃষকরা বাড়তি আয় করতে পারে। এটি এখন লবণাক্ত এলাকায় করা যাচ্ছে। আমরা মনে করছি সারাদেশেই এটি ছড়ানো সম্ভব হবে। তাতে কৃষকরা বাড়তি আয় করতে পারবে।