বুধবার , ডিসেম্বর ২৫ ২০২৪

বাংলাদেশের কৃষির রুপান্তর: কাজী এম বদরুদ্দোজার অবদান -ড. ফা হ আনসারী

বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) এর আয়োজনে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের কৃষির রূপান্তর: কাজী বদরুদ্দোজার আবদান’ শীর্ষক সম্মেলন। সোমবার (২ অক্টোবর) রাজধানীর সিরডাপ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উক্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, এমপি। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এসিআই এগ্রিবিজনেসেস প্রেসিডেন্ট ড. ফা হ আনসারী। সম্মেলনে বাংলাদেশের কৃষি প্রথম রুপান্তরের কারিগর ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. কাজী এম বদরুদ্দোজাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা ছাড়াও ড. আনসারী দেশের কৃষি সেক্টরে বেসরকারি খাতের অবদান ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁর সম্পূর্ণ আলোচনাকে আংশিক পরিমার্জিত করে পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে তুলে ধরা হলো-

ড. কাজী এম বদরুদ্দোজার স্যারকে নিয়ে বলতে গেলে প্রথমে বলতে হয় তার প্রচন্ড স্মরন শক্তির কথা। তিনি প্রায় সভার নাম মনে রাখতে পারতেন এবং নাম ধরে ডাকতেন। জীবীত থাকাকালীন সময়ে আমাকে যতবার দেখেছেন আনসারী বলে ডাকতেন। তিনি এসিআইতে বেশ কয়েকবার এসেছেন এবং কৃষি গবেষণা প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। ড. বদরুদ্দোজার স্যার এসিআই এগ্রিবিজনেস কর্তৃক প্রকাশিত বায়োলাইফ এর একজন নিয়োমিত পাঠক ছিলেন এবং তিনি সবসময় তার মূল্যবান রিভিউ দিতেন।

ড. বদরুদ্দোজা স্যার পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তিনি ছিলেন  শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. নরম্যান বোরলাগের ঘনিষ্ঠ সহযোগিদের একজন। ড. বোরলাগ খাটো জাতের উচ্চ ফলনশীল গমের জাত আবিষ্কারের মাধ্যমে ক্ষধার্ত বিশ্বে সবুজ বিপ্লবের সূচনাকারী ছিলেন।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে ড. বদরুদ্দোজা স্যারের অসামান্য অবদান ছিল। দেশে আধুনিক জাতের গম উদ্ভাবন ও চাষ শুরু হয় ড. বদরুদ্দোজার হাতে, এমনকি ভুট্টার বাণিজ্যিক আবাদও শুরু হয় তাঁর মাধ্যমে। ভুট্টা থেকে তেল উদ্ভাবন ও তা পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের ধারণাটিও তাঁরই ছিল। তাঁর এসব অবদানের জন্য ২০১২ সনে  সরকার তাঁকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ এ ভূষিত করেন।

গবেষণায় এবং শিক্ষায় ড. কাজী এম বদরুদ্দোজার অসামান্য অবদান স্মরনীয় থাকবে। এরই ধারাবাহিতকায় দেশে কৃষি গবেষণায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। কৃষি গবেষণার অবকাঠামো উন্নয়নে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ফিল্ড ল্যাবরেটরি, মলিকুলার ল্যাবরেটরি, অটোমেশন ইন ডাটা কালেকশন, অরজিএ ফ্যাসিলিটি, গ্রিনহাইস, জিনব্যাংক স্থাপন সহ আধুনিক রিসার্চ ক্যাপাসিটি ডেভেলোপমেন্ট করা হয়েছে যা ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন কোম্পানিতে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা অবকাঠামো স্থাপন করা হয়েছে।

কৃষি গবেষণায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে দেশে শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি কোম্পানিগুলো ইরি, সিমিট, সিআইপি, এবিআরডিসি, সিজিআইএআর সহ পৃথিবী বিখ্যাত বীজ কোম্পানির সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ সহ রিসার্চ ক্যাপাসিটি ডেভোলোপমেন্ট করেছে যার মাধ্যমে নতুন নতুন জাতদ্ভউাবন করা সম্ভব হচ্ছে।

সরকারি এবং বিদেশি পার্টনারের কোম্পানির সহযোগিতা নিয়ে দেশে প্রাইভেট সেক্টরে ফিল্ড এবং মলিকুলার ল্যাবে আন্তর্জাতিক মানের রিসার্চ ক্যাপসিটি ডেভেলপ করেছে। সরকার এক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরের সক্ষমতা বাড়াতে আরো কার্যকর ভূমিকা নিলে ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে গতি আসবে।

হাইভ্যালু ক্রপস ড্রাগনফ্রুট, এ্যাবোকাডো, কপি, ক্যাশোনাট, কমলা, ক্যাপসিকাম, অফসিজন তরমুজ সহ ফুল, ফল এবং সবজি ফসলের নতুন নতুন জাত প্রাইভেট সেক্টর দেশে প্রবর্তন করেছে। এটাস ম্ভব হয়েছে সরকারের উদার নীতির কারণে।

এখানে উল্লেখ্য যে, জাপান এবং নেদারল্যান্ডে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী স্বয়ং নিজে উপস্থিত থেকে বিদেশি কোম্পানির সাথে সংযুক্ত করতে প্রাইভেট সেক্টরকে উৎসাহিত করেছেন, এসব সংযোগের ফলে দেশে নতুন নতুন জার্মপ্লাজম আসছে ।

ফসল উৎপাদন সবটাই দেশে প্রাইভেট সেক্টর করে থাকে। ফসল উৎপাদন কাজে আধুনিক চাষাবাদ প্রযুক্তির ব্যবহার, উচ্ছ ফলনশীল, স্বল্পজীবনকাল সম্পন্ন, রোগ-বালাই সহসশীল ক্লাইমেট স্মার্ট জাতের ব্যবহার, যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের ফলে গত এক দশকে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে যা আমাদের কৃষিকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।

কৃষিখামার যান্ত্রিকীকরনে ৪.০ আইআর ব্যবহারে স্কেল আপ করতে হবে। দেশে প্রাইভেট সেকটর বীজ-বপনে: নিউমেটিক প্রিসিশন প্লান্টার, সেচ এবং ফাটিলাইজেশনে-ড্রিপ ইরিগেশন সিস্টেম, এগিয়ে নিচ্ছে ভার্টিকেল ফামিং, ফসল ব্যাবস্থাপনায়- ড্রোন বেসড এরিয়াল ইমাজিং এবং আইওটি বেসড সয়েল মনিটরিংসিস্টেম প্রবর্তন করেছে।

হার্ভেস্টিংয়ে স্মার্ট এসিসটস ব্যবহার করে ওয়ার্কিং এরিয়া, ফলনও ফুয়েল কনসামপশন নির্ণয় করা হচ্ছে, পোস্ট হার্ভেস্টিংয়ে- ব্লকচেইন এবং আরএফআইডি-ভিত্তিক ট্রেসেবিলিটি সমাধান দিয়ে ফসল কাটা পণ্য ট্র্যাকিং ভোক্তা, স্বচ্ছতা এবং খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতেকাজ করে যাচ্ছে।

দেশে সরকারের সাথে সাথে বেসরকারি খাত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এর মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারনে কাজ করে যাচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে কৃষকদেরকে, ডিলার ও সম্প্রাসারণ কর্মীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করছে, অন্যদিকে কৃষিপণ্য বাজারে সংযোগ করে দিচ্ছে। বর্তমানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কর্মসংস্থান তৈরির এক অন্যতম মাধ্যম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং প্রাইভেট এক্সটেনশন সিষ্টেম একসাথে কাজ করলে সরকবা রিবেসরকারি গবেষণা থেকে উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাত বা প্রযুক্তি সহজে দ্রততার সহিত কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। এতে করে কৃষক সহজে প্রযুক্তির সুফল নিয়ে লাভবান হতে পারবে। দেশে মূলত বেসরকারি খাত কৃষিপণ্যে ভ্যালু এডিশন, প্যাকিং ব্যান্ডিং ও ফরওয়ার্ড মার্কেট লিংকেজে কাজ করছে।

ড. বদরুদ্দোজার স্যার এর হাতে গড়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আজকের সফল কৃষিমন্ত্রীর লিডারশীপে বাংলাদেশের কৃষিও এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রাইভেট সেকটর।

কৃষির সাফল্যের এই ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী দিনের কৃষির রুপান্তর ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় লাগবে আরো প্রাইভেট সেকটরের অংশগ্রহণ। সরকারের নীতিগত সহায়তা ও উৎসাহ। ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের আরো অংশগ্রহণ।

আজকের আলোচনা সভাটি কেবল শোকের প্লাটফর্ম হিসাবে নয়, জ্ঞান, উদ্ভাবন এবং মানবতার উন্নতির জন্য নিবেদিত একটি জীবন উদযাপন করার সুযোগ হিসাবে নিতে হবে। ড. কাজী এম বদরুদ্দোজার তিনি কেবল একজন ইমেরিটাস বিজ্ঞানী ছিলেন না, একজন স্বপ্নদর্শী যিনি আমাদের কাজের ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করেছেন। তার কাজ বিজ্ঞানীদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনুপ্রাণিত করবে।

This post has already been read 2986 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …