শনিবার , ডিসেম্বর ২১ ২০২৪

ডিমে ভারি ধাতুর উপস্থিতি : ডিমকে অনিরাপদ করছে কারা?

ফয়জুল ইসলাম মানিক: ক্যান্সার বই প্রকাশ নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত থাকায়, ডিম নিয়ে কোন পোস্ট আজকে দেইনি কিন্তু দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্ট “ঢাকার ছয় বাজারের ডিমে মাত্রাতিরিক্ত ভারী ধাতু” পড়ার পর বাধ্য হলাম কিছু লিখতে।

সকালেই সায়েন্স ডাইরেক্ট থেকে এই রিসার্চ পেপারটা নামিয়েছি, সংক্ষেপে চোখ বুলিয়েছি, ইচ্ছে ছিলো বিস্তারিত পরে লেখবো, কিন্তু কিছু কথা সাধারণ মানুষের জানা দরকার বলে মনে করছি।

উক্ত গবেষণার টাইটেল হচ্ছে, “Intake of toxic metals through dietary eggs consumption and its potential health risk assessment on the peoples of the capital city Dhaka, Bangladesh”

তাদের গবেষণার উপসংহার বা কনক্লুশনটা একটু দেখা যাক। আমি ছবিতে  হাইলাইট করেছি।

সেখানে বলা আছে, বাড়িতে ছেড়ে পালা মুরগির ডিমের সাথে ফার্মে পালা মুরগির ডিমের ট্র্যাস ইলিমেন্ট বা ধাতু বা মিনারেলের পার্থক্য পাওয়া গেছে। উনারা বলছেন, ফার্মের ডিমে অতিরিক্ত পরিমাণে ক্রোমিয়াম (Cr), কপার (Cu), ম্যাঙ্গানিজ (Mn), আয়রন (Fe), সীসা বা লেড (Pb) এবং জিংক (Zn) পাওয়া গেছে। এছাড়া দেশি মুরগির ডিমে ফার্মের মুরগির চেয়ে অতিরিক্ত নিকেল (Ni) এবং কোবাল্ট (Co) পাওয়া গেছে।

উনারা উপসংহারে আরো বলেছেন  যে, তাদের “গবেষণায় পাওয়া এসব ধাতুর অতিরিক্ত মাত্রা” ক্যান্সার সৃষ্টিকরে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে দীর্ঘদিন এগুলো খেলে স্বাস্থের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রথম আলোও রিপোর্ট করেছে যে ম্যাক্সিমাম পারমিসিবল লিমিটের বেশি থাকায় এগুলো মানব দেহে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি, মস্তিষ্কের রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

এবার আসুন, কয়েকটি জিনিসের উত্তর খুঁজা যাক। গবেষণাপত্রে বর্ণিত যে মিনারেলগুলোকে তারা  ক্ষতিকর ভারি ধাতুর কথা তারা বলেছে এগুলোর ভিত্তি কি? এগুলো কি আসলেই ক্ষতিকর ভারি ধাতু না আমাদের দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মিনারেল? ছবিতে এসব মিনারেলের কাজ গুলোও দেয়া আছে, দেখে নিতে পারেন।

কোবাল্ট, কপার, আয়রন, কোবাল্ট, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি আমাদের দেহের জন্য উপকারী মিনারেল বা খনিজ । আমাদের দেহের জন্য প্রায় ৭৬-৮৬ প্রকার মিনারেল দরকার।বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই মিনারেল ডেফিসিয়েন্সিতে ভুগছে, একমাত্র ডিমের মাধ্যমেই এই মিনারেল ডেফিসিয়েন্সি পূরণ করা সম্ভব, অথচ এই গবেষকরা কিভাবে এগুলোকে ভারি ধাতুর কাতারে ফেলে দিলো।

ক্রোমিয়াম দুই ধরনের আছে । একটা ট্রাইভ্যালেন্ট (CrIII) যা মানুষ ও প্রাণির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি পোল্ট্রি ফিডে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ক্রোমিয়ামের হেক্সাভ্যালেন্ট (CrVI) ক্রোমিয়াম বিষাক্ত এবং কার্সিনোজেনিক।

এই গবেষণায় যে Atomic Absorption Spectrometer (AAS, Model: Spectra AA 240FS, Varian, Australia) ব্যবহার করা হয়েছে সেটা কি ক্রোমিয়াম ৩ এবং  ৬ কে আলাদাভাবে শণাক্ত করতে সক্ষম? আপনারা কি নিশ্চিত যে এই মেশিনের মাধ্যমে পোল্ট্রি ফিডে ব্যবহৃত ক্রোমিয়াম ৩ কে শনাক্ত করেছেন নাকি বিষাক্ত ক্রোমিয়াম ৬ কে শনাক্ত করেছেন?

দেশি মুরগিতে যে নিকেল এবং কোবাল্ট বেশি পাওয়া গেলো তাহলে এটাও কি ফার্মের মুরগির মত অনিরাপদ? আপনারা এসব মিনারেলের তথাকথিত উচ্চমাত্রার পেছনের কারণ হিসেবে সেই চর্বিত চর্বণ কথাগুলোই বলেছেন। গবেষকরা দাবি করেছেন, কীটনাশক, ট্যানারি বর্জ্য, অপরিশোধিত নর্দমা এবং খাদ্য উৎপাদন ফ্যাক্টরির অপারেশনের কারণে এসব ভারি ধাতু ঢুকছে খাদ্যে এবং সবশেষ ডিমে!

কীটনাশক খাদ্য তৈরিতে কিভাবে ব্যবহৃত হয়, ট্যানারি বর্জ্য বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, নর্দমা বা অন্য কি উপায়ে এসব ” ভারি ধাতু” ঢুকে সেটার সুষ্পষ্ট  ব্যাখা দাবি করছি।

আমাদের ঢাকার বাতাসেই যেখানে ভারি ধাতু, আমাদের জমি, নদী নালা পুকুরেই যেভাবে বর্জ্য পদার্থ ঢুকছে সেখানে মুরগির ডিমে আমরা তুলনামূলকভাবে অনেক কমই ক্ষতিকর উপাদান পাচ্ছি।

আপনাদের মাথায় কেন ঢুকছেনা, এই মিনারেলগুলো যদি বিষাক্তই হতো, তাহলে মুরগি আগে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতো। এরপর মানুষ খাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতো। অথচ এগুলো অত্যাবশ্যকীয় মিনারেল যা মুরগি এবং মানুষ, সবার জন্যই উপকারী। ডিমের কারণে বিষক্রিয়া বা ব্রয়লার মুরগির কারণে কেউ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে এরকম রেকর্ড কোথাও নেই।

আমাদের দেশের মানুষ প্রতিদিন ডিম খায়না, খাওয়ার ক্ষমতাও হয়নি। অথচ আপনার এমন ভাব করেন যেন মানুষ প্রতিদিন এক কেজি ব্রয়লার মুরগি, ৪ টা করে ডিম খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে!

সব হেভিমেটালই ক্ষতিকর নয়, এটা কেন বুঝতে চান না। Egg Innovation and Strategies for Improvement বইয়ে এই ব্যাপারে বিস্তারিত বলা আছে। হেভিমেটাল আমাদের আশেপাশের পরিবেশ থেকেই আসে, খাদ্য থেকে খুব কমই আসে। হেভি মেটাল কপার এবং আয়রন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে লেড এবং ক্যাডমিয়াম ক্ষতিকর, তাও অতিরিক্ত মাত্রায়। কিন্তু এটা আমাদের পরিবেশের মাধ্যমেই ডিমে, মুরগিতে আসে, খাদ্যের মাধ্যমে আসার সুযোগ কম।

Heavy metals are persistent contaminants in the environment that can cause serious environmental and health hazards. They are released into the environment from natural as well as man-made activities. Some heavy metals, like copper and iron, are essential to maintain proper metabolic activity in living organisms, whereas others, such as lead and cadmium, are nonessential, have no biological role, and are toxic in high concentrations (Li et al., 2005).

আমেরিকা থেকে ড.এরিক বার্গের ট্রেস মিনারেল কয়েক হাজার টাকা দিয়ে কিনে খাচ্ছি যেখানে জিংক, ম্যাংগানিজ, ক্রোমিয়াম,কপার ইত্যাদি ভারি ধাতু রয়েছে! তাহলে কি আমি জেনেশুনে বিষ পান করছি? (ছবি সংযুক্ত)

আমি অনেকগুলো ছবি সংযুক্ত করছি। রেফারেন্স সবগুলোর দেয়া সম্ভব হলোনা, আরেকদিন বিস্তারিত লেখবো আশা করি।

নিরাপদ ডিমকে অনিরাপদ করার পেছনের মানুষগুলোকে চিহ্নিত করা দরকার। বাংলাদেশের পরিবেশকে অনিরাপদ রেখে খাদ্য নিরাপত্তা কখনোই সম্ভব না। উদ্দেশ্যপ্রণিত এসব রিপোর্টের তীব্র নিন্দা জানাই।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ঢাকা, বাংলাদেশ

দাবীত্যাগ: প্রকাশিত লেখাটি সম্পূর্ণই লেখকের মতামত। এক্ষেত্রে এগ্রিনিউজ২৪.কম এর কোন দায়বদ্ধতা নেই।

This post has already been read 6960 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …