ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ৫৫ পয়েন্টে ভাঙন ও বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করেছে লোকালয়ে। লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ভেঙে গেছে ঘর-বাড়ি, ভেসে গেছে ফসলের মাঠ ও মাছের ঘের-পুকুর। এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিতে খুলন্ন মহানগরীর রয়েল মোড়, লবণচরা, টুটপাড়া, মহিরবাড়ি খাল পাড়, শিপইয়ার্ড সড়ক, রূপসা, চানমারী বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
খুলনা জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে জেলার ৭৬ হাজার ৯০৪টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়নের ৫২টি ওয়ার্ড সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড় জলোচ্ছ্বাসে খুলনার আট হাজার ৮৭৫ পুকুর ও মৎস্যঘের ভেসে গেছে। জোয়ারের পানিতে একাকার হয়ে গেছে সব। ফলে দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার মৎস্যজীবীদের অন্তত ১৬৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৬৮ ইউনিয়ন, দুটো পৌরসভা, সিটি করপোরেশন দুটো ওয়ার্ড এলাকায় রিমালের প্রভাব পড়েছে। এতে দুর্গত মানুষের সংখ্যা ধরা হয়েছে চার লাখ ৫২ হাজার। এর মধ্যে এক লাখ ৩৩ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল। বাকিরা নিজেদের বাড়িতেই ছিলেন। বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে খুলনা মহানগরীতেও অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ মানুষ। ঘূর্ণিঝড় চলাকালে বটিয়াঘাটা উপজেলায় গাছ চাপা পড়ে লাল চাঁদ মোড়ল নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি গাওঘরা গ্রামের গহর মোড়লের ছেলে।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল করিম জানান, সোমবার সকালে তিনি একটি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় গাছ ভেঙে পড়ে। গাছের নিচে চাপা পড়ে তার মৃত্যু হয়। ঝড়ে আর কারও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ নাজমুল হুসেইন খাঁন জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমাল তাণ্ডবে খুলনার উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ৫৫টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে ও উপচে প্লাবিত হয়েছে অসংখ্য গ্রাম। এরমধ্যে ৩২টি পয়েন্টে ১ দশমিক ৭০৫ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। আর ২৩টি পয়েন্টের ৩ দশমিক ৬৮৮ কিলোমিটার বাঁধ ওভারফ্লো হয়েছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ। ১২ হাজার ৭১৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমির ধান, পাট, তরমুজ ও সবজি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়াও ৭ হাজার ২৮৩ হেক্টর জমির ৫ হাজার ৫৭৫টি মাছের ঘের এবং ৩০৭ হেক্টর জমির ৩ হাজার ৩০০টি পুকুরের মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলায় পানি প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
জানা গেছে, রোববার দিবাগত রাতে জোয়ারের চাপে মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের সিংহেরকোণা, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের বেলাল গাজীর বাড়ির সামনের বাঁধ ভেঙে গেছে। এছাড়া বাঁধের নিচু কয়েকটি জায়গা ছাপিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এসব জায়গায় এলাকার মানুষ রাতভর মেরামত কাজ চালিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। এতে ভেসে গেছে শতাধিক চিংড়ির ঘের, ভেঙে গেছে কয়েকশ কাঁচা ঘর-বাড়ি ও দোকানপাট।
কয়রা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবিএম তারিক উজ জামান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ও তুলনামূলক নিচু স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন কাজ করছেন। আমি নিজেও সেখানে যাচ্ছি। জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন ঝড়ো বাতাস বইছে। দাকোপ উপজেলার শিবসা ও ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসিয়া গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা তলিয়ে গেছে। উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগী ফকিরকোনা, ঝুলন্তপাড়া এবং পন্ডিতচন্দ্র স্কুল সংলগ্ন এলাকা সম্পূর্ণ প্লাবিত। এ অবস্থায় চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ক্ষিতীশ গোলদার বলেন, একই এলাকায় পাঁচটি পয়েন্ট ভেঙে এখন পানি ঢুকছে। কামিনীবাসিয়া গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় পুরোটা লোনা পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে। এলাকাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩১ নম্বর পোল্ডারের আওতাভুক্ত। তিনি আরও বলেন, এতো উঁচু জোয়ার আগে দেখিনি। ঢাকি ও শিবসা নদীর মোহনায় কামিনীবাসিয়া পুরাতন পুলিশ ক্যাম্প-সংলগ্ন ওই এলাকায় বেড়িবাঁধের অংশ খুব বেশি দুর্বল ছিল না। তবে বেশ কিছুটা নিচু হওয়ায় উচ্চ জোয়ারের চাপে পানি বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে ভেতরে ঢোকে। এরপর বেড়িবাঁধের পাঁচটি পয়েন্ট ভেঙে যায়।
দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়দেব চক্রবর্তী বলেন, জোয়ারের পানিতে দাকোপের বেশকিছু এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। আমার ইউএনও বাংলোর সামনের পুকুর তলিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন,ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ব্যাপক ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। রিমালের তাণ্ডবে স্বাভাবিকের চেয়ে ছয়-সাত ফুট উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে । ভাঙ্গন পয়েন্টে দ্রুত মেরামতের কাজ চলছে এছারাও আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তারা স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের সাথে সমন্ময় করে জিও ব্যাগসহ প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে সর্বাত্বক ভাবে ভাঙ্গনকৃত বেড়িবাঁধের মেরামতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ।