ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল ডাকাতিয়া। খুলনার ফুলতলা, ডুমুরিয়া এবং যশোর জেলার অভয়নগর, কেশবপুর উপজেলা নিয়ে বিল ডাকাতিয়ার বিস্তৃতি। চাষাবাদযোগ্য ৩০ হাজার একর জমিতে উৎপাদন হতো প্রচুর ধান, সবজি এবং মাছ। কিন্তু ভয়াবহ জলাবদ্ধতা আর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে তলিয়ে গেছে বিলের অধিকাংশ জমি। এতে বিপাকে পড়েছেন এখানকার মাছ চাষী, কৃষকসহ সাধারণ মানুষ। ডুমুরিয়ার বিল রক্ষা সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক জি এম আমানুল্লাহ জানান, তিন যুগ ধরে কৃষিজীবী মানুষ জলাবদ্ধতায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পানি নিষ্কাশনের সংযুক্ত হরি নদী, হামকুড়া ও ভদ্রা নদী পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে। শোলমারী নদী দিয়ে কিছু পানি নিষ্কাশন হলেও পলি পড়ে নিষ্কাশন কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার মোঃ আবু বকর সিদ্দিক জানান, টানা বৃষ্টিতে ছোট-বড় মিলিয়ে সাড়ে ১২ হাজার চিংড়ি ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে। আনুমানিক ক্ষতি ৪৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
স্থানীয়রা জানান, বিল ডাকাতিয়ার পানি নিষ্কাশনে সংযুক্ত হরি নদী, হামকুড়া নদী ও ভদ্রা নদী পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এখানকার বর্ষার পানি বের হতে না পেরে সারা বছর ধরেই জলাবদ্ধতা থাকে। বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে ডুমুরিয়া উপজেলার শোলমারী নদীর মুখে বাঁধ দিয়ে ১০ ভেন্টের স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। কিন্তু পলি পড়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে আবারও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বিলে। বর্ষায় তৈরি হয় ভয়াবহ পরিস্থিতি। সরেজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে বিল ডাকাতিয়ার খুলনা অংশে ডুমুরিয়ার ধামালিয়া, রঘুনাথপুর, রুদাঘরা, রংপুর ও গুটুদিয়া পাঁচটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার হেক্টর বিলের জমি পানির নিচে তলিয়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।
ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা রেহেনা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে শোনান জলাবদ্ধতায় তাদের দুর্দশার কথা। তিনি বলেন, তার ফসলি জমির , বাড়ির উঠান, এমনকি ঘরের ভিতরে হাটু পর্যন্ত পানি উঠেছে। রান্না করার কোনো ব্যাবস্থা নাই। বিছানার ওপর বিভিন্ন ধরনের সাপ ও নানা ধরনের পোকা মাকর উঠছে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েকে অন্যরে বাড়ি রেখে এসেছেন। তার একটি পোশা গরুও অন্যের বাড়ি রেখেছেন। ছেলে প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে কাছে রেখেছেন। কিন্তু বাড়ির চারিদিকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় তাকে একা রেখে কাজে যেতে পারছেন না। তেলিগাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র বিল ডাকাতিয়ার বাসিন্দা মুসতাকিম বিল্লাহ আজকের পত্রিকাকে জানায়, মুসতাকিম ও তার বন্ধুরা মিলে রাস্তা দিয়ে হেটে হেটে স্কুলে যেত। কিন্তু এই জলাবদ্ধতার কারনে চারিদিকে পানি জমায় তারা এখন আর নিয়মিত স্কুলে যেতে পারছে না। একই এলাকার পানিবন্দী সিরাজ শেখ আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতি বছর পানি বন্দি থাকতে হয় তাদের। জমির ফসল, মাছের ঘের সব পানিতে তলিয়ে গেছে। চিরা মুরি খেয়ে বেচে আছে। কেউ তাদের দুর্দশা দেখার নাই। তিনি বলেন, সাবেক ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ কখনো তাদের দুর্দশার দুর করনের কোনো ব্যাবস্থা গ্রহন করে নাই।
এদিকে, জলাবদ্ধতা ও ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করে রংপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সমরেশ মন্ডল বলেন, আমাদের ডুমুরিয়ার সবজি সাড়া দেশের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হয়। তবে অতি বৃষ্টির কারণে এ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে বিশেষ করে মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ এলাকার মানুষ অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। বেশিরভাগ মানুষের কাজ নাই। আমরা নিয়মিত খবর রাখছি। অনেকই আমাদের কাছে সাহায্যের জন্য এসেছে। কিছু মানুষকে সাহায্য করেছি এবং বাকিদেরও সাহায়্যের চেষ্টা করছি। জলাবদ্ধতা দূর করার বিষয়ে কাজ করছেন বলেও জানান তিনি।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা বলেন, সাগরের থেকে পলি এসে শোলমারী নদী ভরে গেছে। যার কারণে পানি সঠিক সময় নিষ্কাশন হচ্ছে না। এবার খুনায় রেকর্ড পরিমানের বৃস্টি হয়েছে। যার ফলে এই দুর্যোকটা বড় আকার ধারন করেছে। আমরা ভবদহে ২১ ভেল্ট রেগুলেটর এর উপর ১ কিউমেক ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প লাগিয়েছি। এই পাম্প দিয়ে পানি নিস্কাশন করে ভালো ফল পেয়েছি। একই ধারাবিহিকতায় শোলমারি নদীতে পানি নিস্কাশনের জন্য ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে। জরুরি ভাবে দ্রুত পানি বের করার জন্য ১ কিউমেকের ২ টা পাম্প বসানার প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে ।
জানা যায় ১৯৯০ সালের পর থেকে বিল ডাকাতিয়ায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বিলটিতে বছরের অধিকাংশ সময় থাকে জলাবদ্ধতা। পানিতে তলিয়ে যায় মাঠ-ঘাট, ঘরবাড়ি, রাস্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাছের ঘের, ধান ও ফসলি জমি। ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জলাবদ্ধতা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান স্থানীয়রা।