শনিবার , ডিসেম্বর ২১ ২০২৪

কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং ফার্মিং ও প্রচলিত ডিলার প্রথার ফাঁদ!

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : আমাদের দেশে নতুন হলেও ব্রয়লার কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং কোন অপ্রচলিত পদ্ধতি নয়; বরং এটি ভারতে একটি বহুল প্রচলিত বানিজ্যিক পোল্ট্রি উৎপাদন পদ্ধতি।

ভারতে প্রচলিত পোল্ট্রি কন্ট্রাক গ্রোয়িংকে যেভাবে দেখা হয়, তা হলো- গ্রোয়ার/খামারির সার্ভিস সেল হিসাবে যেখানে খামারিদের নিজের ফার্ম থাকতে হবে, পোল্ট্রি পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

ভারতীয় কোম্পানিগুলো এই পদ্ধতি বা সিস্টেমে যা বলে না, তা হলো- তারা খাদ্য বা বাচ্চা বিক্রি করছে। তারা বলে- তাদের মুরগী অন্যরা পালন করে দিচ্ছে ( সুনির্দিষ্ট সার্ভিস ফি, প্রনোদনা / বোনাসের বিনিময়ে)। এক্ষেত্রে সেদেশের কর্পোরেট কোম্পানিগুলো সব কিছুর যোগান দেয়। প্রান্তিক খামারিরা কেবল তাদের মুরগী পালন করে দেয়। আরো সহজভাবে বললে এখানে শ্রম ও পারিশ্রমিকের বিনিময় হয়। এক্ষেত্রে মুরগী পালন করে দেওয়া খামারি উৎপাদন দক্ষতার জন্য ( এফসিআর, মৃত্যুহার, বেশি/কম ওজন আসা ইত্যাদি প্যারামিটার হিসাবে) সুনির্দিষ্ট সার্ভিস চার্জ পায়। কেউ স্ট্যান্ডার্ড প্যারামিটার  থেকে ভালো ফলাফল করলে অতিরিক্ত বোনাস পায়, যা সার্ভিস সেল বা শ্রম বিক্রির সমতুল্য।

ভারতে এক সময় ডিলার প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। বর্তমানে বড় বড় কর্পোরেট /ইন্ট্রিগ্রেটরা মূলত নিজস্ব খামারে উৎপাদন ও কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং এর মাধ্যমে তাদের কোম্পানির পুরো পোল্ট্রি উৎপাদন ও সাপ্লাই চেইন পরিচালনা করে থাকে।

বাংলাদেশের পোল্ট্রি কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং এর ধারণা ভারতের সিস্টেমকে অনুসরণ করেই চালু হয়েছে। পার্থক্য এটুকুই, এক কোম্পানির থেকে অন্য কোম্পানির চুক্তির শর্তে কিছু ভিন্নতা আছে।

এখন তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং নিয়ে অনেকের আপত্তি কেন? মোটাদাগে এর কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো-

১. কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং এর সরবরাহকৃত ফিড বা বাচ্চার কোয়ালিটি প্রচলিত ডিলার প্রথায় সরবরাহ করা থেকে উন্নত মানের হয় এবং প্রায় সারা বছর কোয়ালিটি একই রকম থাকে (বাজারে প্রচলিত কথা)।

২. বাচ্চার যোগানের ঘাটতি হলে কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার কর্পোরেট কোম্পানিগুলো প্রচলিত ডিলার প্রথায় বাচ্চা সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে, নিজেদের কন্ট্রাক্ট সিস্টেম সচল রাখে। যার ফলে কোম্পানির কিছু অসৎ প্রতিনিধি ও স্থানীয় (জেলা ভিত্তিক) কিছু ডিলার ও ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে উচ্চদামে বাচ্চা বিক্রি করে খামারিদের পকেট কাটে।

৩. স্বাধীন খামারি যাঁরা ডিলার থেকে বাচ্চা ফিড ক্রয় করে ফার্ম  পরিচালনা  করেন, তারা মুরগী রেডি হলে বাজারে বিক্রি করতে গেলে একই বাজারে কর্পোরেটের (সরবরাহের) কারণে  কম দামে মুরগী বিক্রি করতে বাধ্য হন।

যেখানে মূলত কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার/কর্পোরেট কোম্পানির (চুড়ান্ত সুবিধাভোগী) উৎপাদন দক্ষতা ও ফিড বাচ্চার দাম সারা বছর একই রকম থাকার কারণে, মুরগী কম দামে বিক্রি করলেও সব সময় লাভে থাকে, এই কৌশলের কুফল হিসেবে স্বাধীন প্রান্তিক খামারিরা লোকসান দিয়ে ফার্মিং থেকে প্রতিনিয়ত ছিটকে পড়ছেন।

অন্যদিকে কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং এর মুরগী বাজারে আসলে দ্রুত মুরগির দাম কমে যায় এবং প্রান্তিক খামারি লোকসান দেয়। এভাবেই গত কয়েক বছরে হাজার হাজার প্রান্তিক ব্রয়লার খামারি ইতিমধ্যে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, তাঁদের পুঁজি কম থাকার কারণে একবার লোকসান দিলে দ্বিতীয় বার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন না। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পুরো সিস্টেম কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে, লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়বেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে পোল্ট্রি সেক্টরের মাধ্যমে যেভাবে অর্থের প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছিল তা মুখ থুবড়ে পড়বে।

৪. কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং মুরগির বাজারে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে। এই উৎপাদন সিস্টেমের প্রভাবে কখনো ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আবার কখনো ছোট উৎপাদনকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু সুরক্ষিত হয় কর্পোরেট কোম্পানির স্বার্থ ও ব্যবসা এবং তাঁদের ব্যাকওয়ার্ড সাপ্লাই চেইনের বিনিয়োগকৃত পূঁজি (ফিড মিল, ব্রিডার ফার্ম ও হ্যাচারি)

৫.  ব্রয়লার কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং সিস্টেমের কারণে বাজারে  বাচ্চার ঘাটতির সময়ে সিন্ডিকেট সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি হয়। তখন সরকারের বেঁধে দেওয়া থেকে প্রান্তিক খামারিদের অনেক বেশি দামে বাচ্চা কিনতে বাধ্য করে। কারণ খামারি নিরুপায়- তার ফার্ম চালু রাখতে না পারলে কর্মচারী বেতন, লোনের কিস্তি ও সুদ এবং নিজের সংসার চালানোর অর্থ কোথা থেকে আসবে?

অন্যদিকে পোল্ট্রি হাউজ তৈরিতে বিনিয়োগ, যন্ত্রপাতি ক্রয়ের টাকা কিভাবে তুলবে?  চাপে পড়ে ফার্ম চালু রাখতে গিয়ে খামারি বেশি দামে বাচ্চা কিনে আগের থেকেই ঝুঁকি নিয়ে রাখে।

ডিলার প্রথা ও কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং দুই প্রথার প্রচলনের সুযোগে স্বাধীন প্রান্তিক খামারি একদিকে লোকসান দিচ্ছে,অন্যদিকে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ নিয়ে কি ভাবছেন?
ব্রয়লার কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং সিস্টেম কে  ভোক্তা ও খামারি বান্ধব করতে হলে- সরকারের বিশেষত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। খামারিদের ঝুঁকি নিরসনের সুরক্ষা  ব্যবস্থা থাকতে হবে; যা মূলত ব্রয়লার কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং নীতিমালার আলোকেই করতে হবে এবং কৌশলে কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং এর ফাঁদে পোল্ট্রি বাজারের সাপ্লাই চেইনের স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারীদের  বিরুদ্ধে  যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক:
• পোল্ট্রি সাপ্লাই চেইন স্পেশালিষ্ট।
• ই.সি মেম্বার, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন (বিপিআইএ)।
• সমন্বয়ক, পিপিবি।

This post has already been read 1007 times!

Check Also

ডিম-মুরগির যৌক্তিক দাম এবং উৎপাদক-ভোক্তা ভাবনা ও কিছু প্রশ্ন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : একটা বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার এই মূল্য কোন ভাবেই MRP নয়,এটা …