ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা): দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত । এই লবণাক্ত এলাকা বর্ষাকালে শুধুমাত্র আমন ধানের উৎপাদন ছাড়া সারা বছর পতিত থাকে, কারণ এলাকায় জমিতে জোঁ আসে ফেব্রুারি বা মার্চ মাসে, ফলে সেখানে বোরো ধান চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানির স্বল্পতার জন্য চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। এই পতিত জমিতে বিনা চাষে ডিবলিং এবং চারা রোপণ পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিবলিং পদ্ধতিতে নভেম্বর মাসে জমির অপেক্ষাকৃত উঁচু অংশে জমির উপরিভাগ হতে পানি সরে যাওয়ার পর বিনা চাষে নাড়ার মধ্যে বা নাড়া কেটে নির্দিষ্ট দূরত্বে বীজ পুঁতে দেয়া হয় এবং রোপণ পদ্ধতিতে অন্যত্র বীজতলায় চারা তৈরি করে নিয়ে ২০-২৫ দিন বয়সের চারা অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে রোপণ করে দেয়া হয়।
লবণাক্ততা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা, লবণাক্ততা শস্য উৎপাদনের প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং এর ফলে সারা বছর গুটি কয়েক ফসল উৎপাদন করা হয়। বিশেষ করে রবি মৌসুমে কৃষি জমি পতিত থাকে লবণাক্ততার জন্য। শুষ্ক মৌসুমে যদি ভুট্টা চাষ করা যায় তবে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবে এবং আমাদের কৃষিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে। ভুট্টা একটি অধিক ফলনশীল দানাশস্য। ভুট্টা এৎধসরহবধব গোত্রের ফসল যার বৈজ্ঞানিক নাম তবধ সধুং. ভুট্টার আদি নিবাস মেক্সিকো। ভুট্টার ফল মঞ্জরিকে মোচা বলে। মোচার ভেতরে দানা সৃষ্টি হয়। এই দানা ক্যারিওপসিস জাতীয় ফল, এতে ফলত্বক ও বীজত্বক একসাথে মিশে থাকে তাই ফল ও বীজ আলাদা করে চেনা যায় না। ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার পুষ্টিমাণ বেশি। ভুট্টার বাজারমূল্যও অনেক বেশি। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটি ভুট্টা চাষের জন্য উপযোগী।দেশের প্রেক্ষাপটে ভুট্টা একটি সম্ভাবনাময় ফসল বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে যেখানে লবণাক্ততার জন্য চাষিরা ধান ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।
খুলনার লবণাক্ততা গবেষণা কেন্দ্রের জমিতে ২০১৯ সালে পরীক্ষামূলক আবাদে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেছে । গবেষকদের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে স্থানীয় ভাবে কৃষকরা শুরু করেছেন এ পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ। ফলে শুষ্ক মওসুমে লবণাক্ত ও সেচের অভাবে পড়ে থাকা উপকূলীয় এলাকার অনাবাদি প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের আওতায় আনার আশা করছেন গবেষকরা। আর জেকেবিএসপি প্রকল্পের উদ্যোগে এ পদ্ধতি কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় খাদ্য ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, নদী-খাল ভরাট হওয়া আর বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে আবাদযোগ্য জমিতে ক্রমাগত লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৃত্তিকা গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের জরিপ মতে, খুলনার মোট ২ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমির মধ্যে লবণাক্ত জমির পরিমাণ এক লাখ নব্বই হাজার হেক্টর। যা মোট আবাদযোগ্য জমির ৮৯ শতাংশ। এছাড়া লবণ পানির ভয়াবহতার কারনে শুষ্ক মওসুমে সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়ায় প্রতি বছর শুষ্ক মওসুমে উপকূলীয় এলাকায় ৫ লক্ষাধিক হেক্টর জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এসব লবণাক্ত ও খরা প্রবণ জমি আবাদযোগ্য করার লক্ষ্য নিয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প(১ম সংশোধনী), এসআরডিআই অংগ এর আওতায় প্রায় ১শ বিঘা জমিতে চলতি বছর ডিবলিং পদ্ধতিতে ভুট্রা চাষে কৃষকদের সহায়তা দিয়েছে । জেকেবিএসপি প্রকল্প থেকে উপকুলীয় লবণাক্ত অঞ্চলের কৃষকদের প্রশিক্ষন,বিনামুল্যে সার, ডিবলিং চারা এবং জমি তৈরি করতে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ফলে কৃষকরা লাভজনক ডিবলিং পদ্ধতির ভুট্রা চাষ করেছেন। ডিবলিং পদ্ধতিতে ১৫ নবেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চারা রোপন এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফসল কর্তণ সম্ভব। তাই উপকূলীয় এলাকায় উচ্চ লবণাক্ততা আসার আগেই অনাবাদী জমিতে লবন সহিষ্ণু ভুট্টা চাষের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো লক্ষে ডিবলিং পদ্ধতির ভুট্রার আবাদ করছেন স্থানীয় কৃষকরা ।
বটিয়াঘাটা উপজেলার দেবীতলা এলাকার কৃষক অংসুমান রায় ও রজত রায় বলেন, গোপালগঞ্জ, খুলনা,বাগেরহাট,সাতক্ষীরা, পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প(জেকেবিএসপি ) ও মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা কেন্দ্রে দু’টি পদ্ধতিতে ভূট্টো চাষ হচ্ছে জানতে পেরে সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং বিনা মুল্যে সার,বীজ ও জমি তৈরির আর্থিক প্রনোদনা পেয়ে ডিবলিং পদ্ধতির ভুট্রার আবাদ করে লাভবান হয়েছি । চলতি বছর আমরা বিশ বিঘা জমিতে ডিবলিং পদ্ধতির ভুট্রার আবাদ করছি,আশাকরি ভালো ফলন পাবো।
গঙ্গারামপুরের অমুল্য চন্দ্র,আলী হোসেন,প্রিতিস মন্ডল বলেন,আমরা ১৫জন কৃষক এক সাথে জেকেবিএসপি প্রকল্পের সহায়তায় প্রায় ২৫ বিঘা পতিত জমিতে এই দু’টি পদ্ধতিতে ৭টি জাতের ভূট্টার চাষ শুরু করেছি। এতে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। অনেক কৃষক সামনের বছর আমাদের বীজের ব্যবস্থা করার জন্য জানিয়েছে। এই পদ্ধতিতে ভূট্টা জলাবদ্ধতা, খরা ও লবণ সহনশীল। ধান কাটার পর এই সময়টা আমাদের কোন ফসল হয় না। জমি পতিত অবস্থায় থাকে। এই পদ্ধতিতে ভূট্টা চাষে খরচ ও সেচ কম লাগে। একই সাথে পতিত জমিতেই ভূট্টা চাষ করায় ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই। এতে আমরা লাভবান হবো বলে আশাবাদী।
গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প(জেকেবিএসপি )১ম সংশোধনী কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক জানান, দেশের মোট এলাকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ উপকূলীয় অঞ্চল। এর প্রায় ৩০ ভাগ বিভিন্ন ভাবে লবণাক্ত। এটি উপকূলীয় এলাকার একটি বড় সমস্যা। এখানে পানি এবং মাটি দু’টোতেই লবণ থাকে। যার কারণে কৃষক কোন ফসল ফলাতে পারে না। ফলে আমরা কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের ডিবলিং পদ্ধতির ভুট্রার আবাদে প্রশিক্ষণ,বিনা মুল্যে সার,বীজ ও জমি তৈরির আর্থিক সহায়তা দিয়ে কৃষকদের পাশে দাড়িয়েছি। তিনি আরো বলেন,নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে পতিত জমিতে ডিবলিং পদ্ধতিতে ভুট্রার চাষ সম্প্রসারন করতে কাজ করছি। ডিবলিং/ চারা রোপণ পদ্ধতি এর প্রধান সুবিধা এটি মাটির ক্ষয় কমাতে সাহায্য করে। এ পদ্ধতিতে সুবিধা হলো সাধারণভাবে চাষ দিয়ে জমি তৈরি করে ভুট্টা চাষের অন্তত ১/২ মাস আগেই জমিতে বীজ বপন/রোপণ করা সম্ভব হয়, যার ফলে জমিতে লবণাক্ততা বাড়ার এবং ঝড় বৃষ্টি আসার আগেই ফসল তুলে নেয়া সম্ভব হয়। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমের পতিত জমিতে অতিরিক্ত একটি ফসল চাষ করে দেশে ভুট্টার আবাদ বাড়ানো তথা ফসলের নিবিড়তা বাড়ানোর উজ্জ্বল সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা অব্যবহৃত বা পতিত থাকা জমিতে এই ভূট্টা চাষের কারণে ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই।