শনিবার , ডিসেম্বর ২১ ২০২৪

চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সিনবায়োটিক প্রযুক্তির সফলতা পাচ্ছে খুলনার চাষিরা

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব জনিত কারনে মাত্রারিক্ত তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, লবণাক্ততাসহ প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে রোগবালাই, খাবারের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা কারণে গত কয়েক বছর ধরে খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন কমে যায়। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন চাষিরা। বিদেশে আমাদের দেশের সাদাসোনা খ্যাত চিংড়ির চাহিদা রয়েছে। সনাতন পদ্ধতির কারণে দেশে উৎপাদন কম হচ্ছে। তাই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে চিংড়ির উৎপাদন বাড়াতে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় পরীক্ষামূলকভাবে সিনবায়োটিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সফলতা মিলেছে। পরিবেশ বান্ধব নতুন গবেষণার এ পদ্ধতিতে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি, খরচও কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। চার মাস আগে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার একটি ঘেরে নতুন গবেষণা পদ্ধতি সিনবায়োটিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হয়। মাছ তুলে সফলভাবে শেষ হয় পরীক্ষামূলক চাষ।  এ পদ্ধতিতে চিংড়ির উৎপাদনে পাওয়া গেছে ব্যাপক সফলতা।

জলবায়ু পরিবর্তন, রোগমুক্ত পোনা না পাওয়া, ঘেরের গভীরতা কম থাকাসহ বিভিন্ন কারণে গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন ক্রমশ কমছিল। খাবারের মূল্য বৃদ্ধিতে চিংড়ি উৎপাদন খরচও বাড়ছিল। এ অবস্থায় খরচ কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় এবং বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় গবেষণা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড.সৈয়দ হাফিজুর রহমান ‘বাংলাদেশর উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার করে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধের জন্য সিনবায়োটিক প্রযুক্তির ব্যবহার’ বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সহ-গবেষক ছিলেন খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. আছাদুজ্জামান মানিক। খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় সেমি ইনটেনসিভ ও ক্লাস্টার পদ্ধতির ১৮টি পুকুরে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

সিনবায়োটিক প্রযুক্তিটি হলো বিশেষ উপায়ে তৈরি প্রিবায়োটিক ও প্রোবায়োটিকের সংমিশ্রণ যা খাদ্যের সঙ্গে চিংড়িকে খাওয়ানো হয়। পাশাপাশি চিংড়ি খামারের পানিতেও প্রয়োগ করা হয়। চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি ব্যবহারের ফলে চিংড়ি চাষের পরিবেশ উন্নত হয়, ক্ষতিকর রোগ জীবাণু মারা যায়, পানির গুণগত মান বজায় থাকে, চিংড়ির অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায় ফলে চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, উৎপাদনও বাড়ে। খাদ্যের এফসিআর কম হয় ফলে উৎপাদন খরচ কমে। ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায় এই প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও আমাদের দেশে এখনও এটির ব্যবহার শুরু হয়নি। সিনবায়োটিক নামের এই প্রযুক্তির প্রথমবারের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয় ডুমুরিয়া উপজেলার চিংড়ি ঘেরে। ফলাফলে দেখা যায় সাধারণ পদ্ধতি থেকে এ পদ্ধতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ, আর খরচ কম হয়েছে অন্তত ২৫ শতাংশ। তাতে হাসি ফুটেছে চাষিদের মুখে। এ পদ্ধতির চাষে আগ্রহ বাড়ছে তাদের।

সিনবায়োটিক প্রযুক্তি গবেষণা করা ঘেরের মালিক কৌশিক বাগচি বলেন, আমি গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে চিংড়ি চাষ করে আসছি। তবে গত কয়েক বছর ধরে উৎপাদন কমে আসছিল। টিকে থাকাই কষ্ট হচ্ছিল। চাষের শুরুতে আমরা ভালো মানের পোনা পাই না, ঘেরের গভীরতা বাড়াতে গেলে যে খরচ তা করতে পারি না, সেইসঙ্গে অতিরিক্ত তাপে আর বন্যায় চিংড়ি মারা যেত নিয়মিত, ফলে উৎপাদন খুব কমে আসছিল। তবে এবার নতুন এই পদ্ধতি আমার ঘেরে চাষ করা হয়। দেখা যাচ্ছে উৎপাদন বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ, খরচ কম হয়েছে অন্তত ৩০ শতাংশ।

ডুমুরিয়া উপজেলার চাষি মো. মিলু বলেন, কৌশিক বাগচির চাষের এই সফলতা আমাদের আগ্রহী করে তুলছে। গত কয়েক বছর ধরে টানা লোকসানে আমরা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম। তবে এ পদ্ধতি আমাদের আগ্রহী করে তুলেছে। আগামীতে এ পদ্ধতিতে আমি চিংড়ি চাষ করতে চাই। গবেষণা সংশ্লিষ্টদের দাবি, পরিবেশবান্ধব সিনবায়োটিক প্রযুক্তিতে চিংড়ি চাষের পরিবেশ উন্নত হয়, ক্ষতিকর রোগ জীবাণু মারা যায়, পানির গুণগত মান বজায় থাকে, উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির ফলে চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, উৎপাদনও বাড়ে। সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপরিচালক সরোজ কুমার মিস্ত্রী বলেন, চিংড়ি চাষে সিনবায়োটিক ব্যবহার বিষয়ক গবেষণাটি বাগদা চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে এবং চাষিদের মনে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। এটি মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে পারলে চিংড়ি সেক্টরে পরিবর্তন ঘটানো যেতে পারে।

সফলতা মেলায় এ পদ্ধতি সাধারণ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল। তিনি বলেন, নতুন এই পদ্ধতির সফলতায় চাষিদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিচ্ছে। তবে এখনও গবেষণা বাকি আছে। আমরা আশা করছি গবেষণার এই সফলতা আরও বাড়বে। আমরা এই প্রযুক্তি সাধারণ চাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা করছি। এটা করতে পারলে দেশে চিংড়ির উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় সেমি ইনটেনসিভ ও ক্লাস্টার পদ্ধতির ১৮টি পুকুরে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

This post has already been read 442 times!

Check Also

খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রির ভূমিকা জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে

গাজীপুর সংবাদদাতা: কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) গাজীপুরে বাংলাদেশ …