মসিউর রহমান: পোল্ট্রিকে নিয়ে সারা বিশ্বে মানুষের প্রত্যাশা দিন দিন বাড়ছে। যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে এবং নগরায়ণ, মিল-ফ্যাক্টরি, রাস্তা-ঘাট নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে যেভাবে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে; যুদ্ধের কারণে দীর্ঘমেয়াদে নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা; তাতে মানুষকে তিনবেলা খাওয়ানো আগামী দিনগুলোতে আরো এক যুদ্ধের মত কাজ হয়ে দাঁড়াবে। সে বাস্তবতায় কম জমি ব্যবহার করে অধিক খাদ্য ও পুষ্টি উৎপাদনের যে কৌশল বা সুবিধা পোল্ট্রি শিল্পে রয়েছে- তা আমাদের আশান্বিত করে।
নিরাপদ ও স্বাস্থসম্মত প্রাণিজ আমিষ
এখন উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি আমরা নিরাপদ ও স্বাস্থসম্মত প্রাণিজ আমিষের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। এজন্য এন্টিবায়োটিকের অযাচিত ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। খামারিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতিমালার সংশোধন ও সঠিক প্রয়োগ করতে হবে।
পরিবেশগত স্থায়িত্ব
পৃথিবীর অস্তিত্বের স্বার্থে পোলট্রি খাতের সাসটেইনেবিলিটি’র পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি’র কথাও আমাদের ভাবতে হবে। সচেতনতার অভাবে নানাভাবেই আমরা পরিবেশের ক্ষতি করছি। অনেকেই খামারের পাশে কিংবা ফিড মিলের পাশের এলাকায় ময়লার স্তুপ কিংবা গন্ধের অভিযোগ করে থাকেন। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেকে খামারের বর্জ্য নদীতে বা ডোবাতে ফেলছেন- এমন অভিযোগও আছে। অনেক খামারি- রোগাক্রান্ত মৃত মুরগি আশেপাশের খোলা জায়গায় ফেলে দেন। এতে শুধু যে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, তাই নয়। ঐ মৃত মুরগিকে একদিকে যেমন নিজের খামারের মুরগিগুলো রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়, তেমনিভাবে আশেপাশের খামার কিংবা নিকটবর্তী এলাকাতেও জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকিতৈরি হয়। ফলে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার বাড়তেই থাকে।
নিরাপদ পোলট্রি উৎপাদন
পরিবেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে পোল্ট্রির উৎপাদনের স্বার্থে, নিরাপদ ডিম ও মুরগি উৎপাদনের স্বার্থে সর্বোপরি আগামীর পৃথিবী ও ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে আমাদেরকে নিরাপদ পোলট্রি উৎপাদনের দিকে যেতেই হবে।
কিভাবে নিরাপদ পোলট্রি উৎপাদন নিশ্চিত হবে?
যদি আমরা নিরাপদ পোলট্রি উৎপাদন নিশ্চিত করতে চাই, তবে এখনই আমাদের কে বেশ কিছু বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
(১) প্রতিটি খামার নিবন্ধিত করতে হবে।
(২) সকল ব্রয়লার ও লেয়ার খামারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (Waste Management) বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকলে বাণিজ্যিক খামার, ব্রিডার ফার্ম ও হ্যাচারিকে নিবন্ধন দেয়া যাবে না।
(৩) সকল বড় বাণিজ্যিক লেয়ার খামার ও ব্রিডার ফার্মের ক্ষেত্রে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট/জৈবসার কারখানা স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
(৪) ছোট-বড় সব ধরনের খামারের জীবনিরাপত্তা উন্নত করতে হবে।
(৫) এন্টিবায়োটিকের অযাচিত ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
(৬) ছোট খামারিরাও কিভাবে এন্টিবায়োটিক রেসিডিউ মুক্ত ডিম-মুরগি উৎপাদন করতে পারে সেজন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৭) এ ধরনের কিছু ডেমনস্ট্রেশন ফার্মতৈরি করতে হবে এবং খামারিদের দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
(৮) পোল্ট্রি রিসাইক্লিংকে উৎসাহ দিতে হবে।
(৯) পোল্ট্রি লিটার থেকে জৈবসার, বায়োগ্যাস ও বিদ্যুৎউৎপাদনে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করতেহবে।
(১০) এ ধরনের প্রযুক্তি আমদানিতে শূণ্য শুল্ক সুবিধা প্রদান করতে হবে।
পোল্ট্রিরেন্ডারিং থেকে বায়োগ্যাস, জৈব সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন
সামান্য কিছু বিনিয়োগ ও স্বদিচ্ছা থাকলে আমরা পোল্ট্রি বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করতে পারি। বাংলাদেশে সপ্তাহে ব্রয়লার ডিওসি’র উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ, লেয়ার ডিওসি ১২ লাখ, কালার ডিওসি ৩০ লাখ, সোনালী ডিওসি প্রায় ১৮-২০ লাখ। আমাদের দেশে বর্তমানে মোট খামারের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। বর্তমানে যে পরিমাণ মুরগি আছে এবং প্রতিদিন যে পরিমাণ ড্রপিং হয়; তা থেকে প্রচুর পরিমান জৈব সার, বায়োগ্যাস এবং বিদ্যুৎউৎপাদন করা সম্ভব।
দেশে প্যারাগন গ্রুপ এবং কাজী ফার্মস বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। বর্তমানে আমাদের খামারে প্রতি প্তাহেস প্রায় ২১০ টন জৈব সার উৎপাদিত হচ্ছে। এখান থেকে কার্বন ক্রেডিট জেনারেট করা বা কার্বনইমিশন কমানোর জন্য প্যারাগন কাজ করছে। উল্লেখিত পদ্ধতি অবলম্বন করে কি পরিমান জৈব সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব; সে ব্যাপারে আপনাদের কিছুটা সম্যক ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছি:
১ লাখ বার্ড থেকে দৈনিক
বায়োগ্যাস উৎপাদন সম্ভব = প্রায় ৯,৬৮.৫৬ কিউবিক মিটার।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব = প্রায় ১৯৩৭.১৩ কিলোওয়াট ঘন্টা/দৈনিক
জৈব সার উৎপাদন সম্ভব = প্রায় ৮০০ কেজি/দৈনিক
যদি ২ কোটি বার্ডের হিসাব ধরা হয় ,তবে দৈনিক:
বায়োগ্যাস উৎপাদন সম্ভব = প্রায় ে৯৬,৮৫৬ কিউবিক মিটার
বিদ্যুৎউৎপাদন সম্ভবসম্ভব = প্রায় ১৯,৩৭১ কিলোওয়াট ঘণ্টা/দৈনিক
জৈব সার উৎপাদন সম্ভব = প্রায় ৮০,০০০ কেজি/দৈনিক
২০৫০ সাল নাগাদ পোল্ট্রি শিল্পের যে রোডম্যাপের কথা ভাবা হচ্ছে তাতে উৎপাদন বর্তমানের দ্বিগুণ হবে। সে হিসেবে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ জৈব সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। ঐ বিদ্যুৎ দিয়েই খামারের মোট চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ করা সম্ভব।
রূফটপ সৌর প্যানেল
রূপটপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমানে প্য্যারাগন গ্রুপের উৎপাদন সক্ষমতা হচ্ছে ৯.৬ মেগাওয়াট। প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে ৩৪ হাজার ৬৬৬ কিলোওয়াট-ঘন্টা। ২০২৫ সাল নাগাদ সক্ষমতা হবে প্রায় ১৫.৫৩ মেগাওয়াট। এছাড়াও বর্তমানে আমাদের ৮টি সোলার প্রজেক্টের কাজ চলছে। ২০২৮ সন নাগাদ সক্ষমতা দাঁড়াবে ৫৪.৫৩ মেগাওয়াট।
কত ক্রেডিট জেনারেট করছি বা করতে পারবো?
ইন্টার স্টেট রিনাউয়েবল এনার্জি কাউন্সিল (IREC) থেকে বর্তমানে আমরা বছরে প্রায় ৯৮১১ ক্রেডিট জেনারেট করছি। অর্থ মূল্যে বছরে প্রায় ৪৪ হাজার ১৫০ ডলার। ২০২৫ সন নাগাদ ১৭,৭৩৯ ক্রেডিট জেনারেট করতে পারবো বলে আশা করছি।