শুক্রবার , ডিসেম্বর ২০ ২০২৪

ডিম, মুরগি ও ফিড উৎপাদনে ধ্বসরে আশংকা

বিশেষ সংবাদদাতা : পোল্ট্রি শিল্পের প্রাণকেন্দ্র বলা হয়ে থাকে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারি ব্রিডার্স শিল্পকে। বছরজুড়ে চাহিদা অনুযায়ী ডিম ও মুরগির মাংসের সরবরাহ নির্ভর করে মূলত: এ খাতটির উপর। শুধু তাই নয়, ফিড ইন্ডাষ্ট্রির অস্তিত্বও অনেকাংশে এখাতটির উপর নির্ভরশীল। বাচ্চার উৎপাদন কমে গেলে- ডিম ও মুরগির মাংসের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়; আবার চাহিদার অতিরিক্ত বাচ্চা উৎপাদিত হলেও বাজারে ডিম-মুরগির দরপতন ঘটে, প্রায়শই উৎপাদন খরচের চেয়েও কম মূল্যে ডিম ও মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হন খামারিরা। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে, অব্যাহত লোকসানের চাপ সইতে না পেরে বন্ধ হয় খামার, ফলে হ্রাস পায় উৎপাদন; পরিণতিতে নতুন করে বাড়ে ডিম ও মুরগির দাম। গ্রামীণ জনপদে বাড়ে বেকারত্ব ও দারিদ্র; অপ্রত্যাশিত পুষ্টি ঘাটতির শংকা বাড়ে; সামষ্টিক অর্থনীতিতে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। এ বাস্তবতার কারণেই পোল্ট্রি ব্রিডার শিল্পের ক্রমাগত লোকসানকে সামগ্রিকভাবে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পের জন্য অশনীসংকেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আজ (১৯ ডিসেম্বর) ‘ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (বিএবি) এর বার্ষিক সাধারণ সভায় এ উদ্বেগের কথা তুলে ধরা হয় এবং ব্রিডার শিল্পসহ সামগ্রিকভাবে পোল্ট্রি ও ফিড শিল্প রক্ষায় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।

২০২৪ সালকে ব্রিডার্স শিল্পের জন্য দুঃসময় বলে মন্তব্য করেন- একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা (ডিওসি) উৎপাদনকারিদের সংগঠন ‘ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (বিএবি) -এর সভাপতি মাহাবুবুর রহমান।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক (জিপি) ও প্যারেন্টস্টক (পিএস) বাচ্চার দর বৃদ্ধি, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, কোটা বিরোধী ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, কারফিউ, অপ্রত্যাশিত বন্যা, অতিবৃষ্টি, হিট-ওয়েভ, রোগজীবাণুর সংক্রমণ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, সরকারের ডিম আমদানির সিদ্ধান্তসহ নানান কারণে পোল্ট্রি ব্রিডার্স শিল্পের জন্য চলতি বছর ছিল একটি লোকসানী বছর।

বিএবি সভাপতি বলেন, এ বছর অনেক ছোট-মাঝারি এমনকি বড় ব্রিডার ও বাণিজ্যিক খামারও বন্ধ কিংবা বিক্রি হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বড় অংকের ব্যাংকের দেনার মুখে পড়েছে। কখনও উৎপাদন কমেছে আবার কখনও অতিরিক্ত উৎপাদন হয়েছে। আর এ অস্থিরতায় ব্রিডার খামার ও হ্যাচারি প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান করলেও সুযোগ সন্ধানী মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ঠিকই মুনাফা করেছেন। মূলত: মধ্যস্বত্ত্বভোগী এ শ্রেণিটিই তাঁদের মুনাফা-সহায়ক পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখতে গণমাধ্যমের কাছে মনগড়া তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে উৎপাদনকারিদের ভিলেন হিসেবে চিত্রায়িত করেছে এবং তা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, উৎপাদনকারিদের শত্রু বানিয়ে কিংবা ক্ষতি করে- উৎপাদন, অর্থনীতি কিংবা উন্নয়ন কোনোটাই বেগবান করা সম্ভব নয়। উৎপাদনশীলখাত বড় হলেই বিনিয়োগ বাড়বে, উদ্যোক্তা বাড়বে, দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে। তিনি বলেন, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ব্রিডার্স শিল্পে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। এ লোকসান সমন্বয়ের সুযোগ দিতে হবে, যথাদ্রুত সম্ভব নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য পুণঃমূল্যায়ন করতে হবে, প্রয়োজনে আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিএবি’র সাধারণ সম্পাদক শাহ্ ফাহাদ হাবীব বলেন, অংশীজনদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে; এমনকি চাহিদা ও সরবরাহের মাঝে ভারসাম্য রক্ষায় একটি কৌশলপত্রও প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু তারপরও সরকার নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, যেদিন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় সেদিনই তা হ্যাচারি থেকে বিক্রি করে দিতে হয়। এটি এমন একটি প্রোডাক্ট- যা কোনভাবেই সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়।  এই পরিস্থিতিরই সুযোগ নেয়- পাইকারি ক্রেতারা। তাঁরা সারাদিন বাচ্চা না কিনে বিকাল-সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখে- যেন হ্যাচারিরা কম দামে বাচ্চা বিক্রি করতে বাধ্য হন।

শাহ্ ফাহাদ বলেন- মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারিরা পাইকারি ক্রেতাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থা থেকে মুক্তি না মিললে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।  ফাহাদ হাবীব বলেন, মার্চ ও এপ্রিল এবং অক্টোবর ও নভেম্বর- এই চার মাসে সামান্য কিছু লাভ হলেও বছরের বেশিরভাগ সময় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে বাচ্চা বিক্রি করতে হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর একদিন বয়সী ব্রয়লার বাচ্চার সর্বোচ্চ যৌক্তিক মূল্য ৫৩ টাকা নির্ধারণ করেছিল। অতিরিক্ত উৎপাদন খরচ এবং লোকসান সমন্বয় করতে মূল্য সংশোধনের জন্য একাধিকবার সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হলেও আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। চলতি বছর ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রি হয়েছে গড়ে প্রায় ৪৫ টাকায় যেখানে সরকারের অনুমোদিত মূল্য ৫৩ টাকা। কোন কোন মাসে লক্ষ্যণীয়ভাবে দরপতন ঘটেছে যেমন: জুলাই ও আগষ্ট মাসে সর্বনিম্ন দাম ছিল ২৫ টাকা, মে মাসে ৩০ টাকা, জুনে ৩২ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৩৮ টাকা এবং ডিসেম্বরে ৩৮ টাকা।

প্রভিটা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুন নবী ভূঁইয়া বলেন, ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের সুদের হার, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ডলারের দাম আরও একধাপ বেড়েছে কিন্তু মুরগির বাচ্চার দর বাড়ছে না বরং কমছে। আজকে অর্ডার দিলে নূন্যতম ৪৫ দিনের আগে পিএস বাচ্চা পাওয়ার আশা করা যায় না। আর বিদেশ থেকে পিএস বাচ্চা পেতে হলে নূন্যতম ১২০ দিন আগে বুকিং দিতে হয়।

নুরুন নবী বলেন- ঋণপত্র (এল.সি) খুলে বাচ্চা আমদানি করে উৎপাদন খরচ যা পড়ছে, ডিওসি বিক্রি করে সে খরচ তোলা যাচ্ছেনা। তিনি বলেন, পাইকারি বিক্রেতারা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এম.আর.পি’র চেয়েও অধিক মুল্যে বাচ্চা বিক্রি করেছেন অথচ এজন্য ব্রিডার ফার্মগুলোকে দোষী করা হয়েছে কিন্তু অন্যায্য মুনাফা লুটেছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। এদের দৌরাত্ম্য কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা।

তিনি আরো বলেন, ব্রিডার কোম্পানীগুলো- সাধারণ খামারিদের কথা ভেবেই নূন্যতম দামে ডিওসি বিক্রি করছে। তাঁরা যদি এম.আরপি’র অতিরিক্ত দামে বাচ্চা না কিনতো তবে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা অতিরিক্ত মুনাফা করতে পারত না। তিনি বলেন, উৎপাদনকারিরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংকের ঋণে জর্জরিত হচ্ছে কিন্তু মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ঠিকই দিন দিন ফুলে ফেঁপে বড় হচ্ছে কারণ তাঁদের তো কোনো ঝুঁকি নেই।

নারিশ পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারির পরিচালক, শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ব্যাংকের সুদের হার ১৪ শতাংশ অথচ মুরগির বাচ্চার যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের সময় নাম মাত্র মুনাফার হার ধরা হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ডিমের যে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে সেখানে উৎপাদক পর্যায়ে মুনাফার হার ধরা হয়েছে মাত্র ৩.৮০ শতাংশ; প্রতি কেজি সোনালী মুরগি উৎপাদনে ৪ শতাংশ এবং ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে মাত্র ৫ শতাংশ। দেশে এমন একটি খাতও নেই যেখানে ১৫ শতাংশের কম লাভ অনুমোদন করা হয়েছে। তাই সবচেয়ে সংবেদনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ খাত- পোল্ট্রি ও ব্রিডার্স ইন্ডাষ্ট্রি’র জন্য নির্ধারিত মুনাফার হার পুনঃনির্ধারণ করা প্রয়োজন।

খালেদ বলেন- এত ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করার পরও যদি বিনিয়োগকারিরা নূন্যতম মুনাফা করতে না পারেন; উল্টো মিডিয়ায় মিথ্যা অপবাদ ছড়ানোর মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়, তাহলে এ খাতে বিনিয়োগকারিদের ধরে রাখা কঠিন হবে। মনে রাখতে হবে- এটি একটি লাইভ ইন্ডাষ্ট্রি। এ খাতটি মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ধবংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু গড়তে হলে বছরের পর বছর সময় লাগবে। শুধু তাই নয়, একবার উৎপাদন কমে গেলে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতেও অন্তত: ৩-৪ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। সাধারণ মানুষ বা ভোক্তারা এ প্রোডাকশন সিস্টেম সম্পর্কে জানেন না বলেই অনেক সময় তাঁরা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হন।

নাহার এগ্রো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রকিবুর রহমান টুটুল বলেন, আমাদেরকে যে কোনো মূল্যে বাজার স্থিতিশীল রাখতে হবে। যে সিজনে যতটুকু চাহিদা, সে অনুযায়ীই উৎপাদন করতে হবে।

বিএবি নেতৃবৃন্দ বলেন- প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে যে কৌশলপত্রটি প্রণয়ন করা হয়েছে তা প্রতি ৩ মাস পরপর পুণঃমূল্যায়ন করতে হবে, সরকার নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য- উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে, সরকার যেহেতু সর্বোচ্চ যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছেন সেহেতু উৎপাদনকারি ব্রিডার ফার্মগুলো যেন সে দামে বাচ্চা বিক্রি করতে পারেন সেটি নিশ্চিতেও সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে; ঝুঁকি বিবেচনায় পোল্ট্রি ও ব্রিডার্স শিল্পের জন্য সুদের হার নূন্যতম করতে হবে; সর্বোপরি প্রান্তিক খামারিরা যেন ডিম ও মুরগির নায্য দাম পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

তাঁরা বলেন, পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের জন্য একটি মহল সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করছে। প্রান্তিক খামারিদের নাম ভাঙ্গিয়ে তাঁরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। ১ জানুয়ারি থেকে ডিম ও মুরগির উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে তাঁরা দেশকে অস্থিতিশীল করার নতুন এক চক্রান্তে মাঠে নেমেছে। এদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নিলে তারা দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংস করবে এবং দেশের বাজারকে অপশক্তির হাতে তুলে দিতে সফলকাম হবে।

This post has already been read 157 times!

Check Also

ডিমের মূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

পাবনা সংবাদদাতা: ডিমের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় সমস্যা উল্লেখ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা …