শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

কৃষিবিদদের বন্যা পরবর্তী সংগ্রাম -প্রেক্ষাপট জয়পুরহাট

1011মতিয়র রহমান মুন্না: আজ আপনাদের একটা গল্প শুনাবো। যে গল্পের কারিগর সকলের আড়ালে নিভৃতে কাজ করে যাওয়া একদল কৃষিবিদ। যারা প্রায় সবসময়ই ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচার থেকে অনেক দূরে থাকেন, কাজ করেন আপন মনে। দেশকে ভালোবাসেন অন্তর দিয়ে। মাটি মানুষের সাথে মিশে পুরো দেশের মানুষের অন্ন যোগানে নিজেদের সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন অনবরত। সংগ্রামী কৃষকদের সাথে রৌদ্রে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে- মাঠের মাটি থেকে দেশের মানুষের মুখে তুলে দিচ্ছেন বেঁচে থাকার নিত্য প্রয়োজনীয় অন্ন। বছরের পূর্ব পরিকল্পনা আর অনাকাঙ্খিত প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্নের অবস্থানে। বেঁচে রাখছেন আমাকে আর আপনাকে।

কথা বলবো, জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল থানাকে নিয়ে। তুলশীগঙ্গা, হারাবতী ও ছোট যমুনা নদীর অববাহিকা ধরে সাম্প্রতিক সময়ের বন্যা এখানেও আগ্রাসী রূপে হানা দিয়েছে। ঘরবাড়ি, চাষের পুকুরের মাছসহ- সহায় সম্পত্তি হারানোর পাশাপাশি কৃষি নির্ভর এ এলাকার মানুষেরা তাদের মাঠের ফসলও হারিয়েছে এ বন্যায়। সদ্য লাগানো মাঠের আমন ধান বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে থেমে গেছে প্রান্তিক কৃষকের জীবনের সব গল্প। জীবিকা উপার্জনের একমাত্র পথ অবরুদ্ধ। যতদূর চোখ যায় অথৈ পানি, যত বেশি চিন্তার গভীরতা তত বেশি অন্ধকার। ঠিক এ সময় সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে বন্যার্তদের সাহায্যের আবেদন। অনেকেই এগিয়ে গেছেন। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই সেই সব মানুষের প্রতি যারা মানবতার ফেরি করে অনাহারী মানুষের মুখে বেঁচে থাকার জন্য সাময়িকভাবে অন্ন তুলে দিয়েছেন। অভিনন্দন জানাই সেই সব মানুষের প্রতি যারা মানবতার ফেরিওয়ালাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের সাহায্যের হাত। জয়পুরহাটের বানভাসী মানুষের সচিত্র তথ্য দিয়ে দেশিবাসীকে সবসময় জাগ্রত রাখতে সহায়তা করা সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন রিপোর্টারসহ গণমাধ্যমের সকল সাংবাদিক ভাইদের প্রতি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানাই।

হয়তোবা কিছু দিনের মধ্যেই বন্যার পানি নেমে যাবে। কোনো রকমে দাঁড়িয়ে থাকা মাটির ঘরে ফিরবে জয়পুরহাটের ঘরহারা মানুষ। তারপর? তারপর তাঁরা খাবেন কি?

প্রশ্নটা এখানেই। পুকুরে কোন মাছ নেই। মাঠে কোনো ফসল নেই। জীবন চালানোর জন্য এখানকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষি জমির উপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু সে আশা গুঁড়েবালি। আমন ধানের মৌসুমে অক্ষত জেলাগুলোর ধানে কুশি এসেছে। আর বন্যাকবলিত এ এলাকায় নতুন করে ধান লাগানোরও কোনো উপায় নেই। নতুন চারা গজাতেই লাগবেই প্রায় পনের দিন। কিন্তু বীজ কেনার অর্থ কোথায়? যা পুঁজি ছিল বন্যার পানিতে ধুয়ে গেছে নির্মমভাবে। তাহলে কি সর্বস্বহারা এ মানুষগুলোর চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার?

অবশ্যই না। কবি সুকান্তের “সাবাস বাংলাদেশ”-এর মানুষেরা আজীবন সংগ্রামী। এ দেশের কৃষকের জীবন যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি সাহসিকতার গল্প দিয়ে ভরা। কিন্তু আজকে আমার এই গল্পের দুঃসাহসী নায়ক কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। সরকার ও একদল কৃষিবিদের বুদ্ধিমত্তা। ক্ষেতলাল থানার ১১ হাজার ৬৮৩ হেক্টর কৃষি জমির মধ্যে প্রায় ২৫০০ হেক্টর জমিই (প্রায় ২১.৩৭ শতাংশ) বন্যার ভয়াল থাবায় ক্ষত বিক্ষত। সবুজ মাঠের পরিবর্তে সেখানে বন্যার ঘোলাটে পানিতে থৈ থৈ করছে চারিদিক। সরকারের নির্দেশনায় জয়পুরহাটের এই ক্ষেতলাল থানায় চলছে বন্যা পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলা প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে সরকারী দলের স্থানীয় শাখা, উপজেলা পরিষদ ও কৃষি বিভাগ সম্মিলিত উদ্যোগে প্রায় ৪.৫ মেট্রিকটন ধানের বীজ বিতরণ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে। কঠিন সংগ্রামের এ দিনগুলিতে স্থানীয় কৃষক ভাইয়েরা প্রাপ্ত এ সহায়তা থেকে এবং তাঁদের নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যার ক্ষত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। যতদূর শুনেছি, ব্রি ধান ৩৪, ব্রি ধান ৬২ ও বিনা-৭ এই তিন জাতের ধানের বীজতলা প্রস্তুত করা হচ্ছে। ১.৫ একরের এই বীজতলা দিয়ে ১৫ দিন পরেই লাগানো যাবে প্রায় ১৫০ বিঘা জমি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১০০-১১৫ দিনের মধ্যেই এ ফসল কৃষকদের ঘরে উঠবে। মহৎ একাজে অর্থলগ্নি করছে উপজেলা পরিষদ। জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নির্দেশনায় স্থানীয় পর্যায়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার তত্ত্বাবধায়নে এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে মাঠে কৃষকদের সাথে সরাসরি কাজ করছেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা। উদ্দেশ্য একটাই- বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বন্যা কবলিত এলাকার কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে ধানের চারা বিতরণ করা, যেন দুঃসময়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন অসহায়-সম্বলহীন কৃষকেরা। বুকে হাত রেখে বলতে পারি, কাউকে ১০ টাকা অর্থ সাহায্য কিংবা এক মুঠো খাবার দিলে সাময়িক অন্নের প্রয়োজন মিটতে পারে কিন্তু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিলে ভাগ্য ঘুরে যেতে পারে যেকোনো সময়। কৃষি বিভাগ সেই কাজটিই করছে, যেটাতে সহানুভূতির চেয়ে ভালোবাসা অনেক বেশি। যে ভালোবাসা আগামী দিন কেমন হবে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করার উৎসাহ প্রদান করে। দেশের আগামী দিনের অন্ন যোগানে সাহসী হতে শেখায়। কৃষিবিভাগ আর কৃষিবিদদের কাজের সাথে অন্যান্যদের পার্থক্য এখানেই।

আমি একজন কৃষি শিক্ষা অনুরাগী। গর্ব করে বলতে হয়, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি- সেখানে সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীর অংশগ্রহণে মোট ১১ লাখ টাকা বন্যার্তদের জন্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। আমার নিজের জন্মস্থান জয়পুরহাট জেলার সকল উপজেলা কৃষি অফিস স্থানীয় উপজেলা পরিষদের সাথে যৌথভাবে বন্যা পরবর্তী দূর্যোগ মোকাবেলায় কাজ করছে। নিজে বেঁচে থেকে দেশের বাঁচার লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে আমার দেশের সেরা কৃষিবিদ- আমাদের কৃষক ভাইয়েরা। সর্বস্থানে কৃষিবিদদের সংগ্রাম চোখে পড়ার মতো। তাই প্রাণ খুলে গর্ব করে বলতে ইচ্ছে করে- ভালোবাসি কৃষিকে। ভালোবাসি কৃষককে। স্বপ্নের সোনার বাংলা এগিয়ে যাক। সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হোক বাঙালীর মস্তক।

  • শিক্ষার্থী (মাস্টার্স), কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

This post has already been read 6852 times!

Check Also

খামারীদের টাকা নিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নয়-ছয়ের অভিযোগ!

মো. মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর সংবাদদাতা) : চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ ও উত্তরে ১৬০ জন খামারীর প্রত্যেকের …