ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা):
সাদা মাছের পোনা বদলে দিয়েছে খুলনার কয়েকশ পরিবারের জীবনযাত্রা। আগে যে পরিবারগুলোর সংসার অভাব অনটনে চলতো, সময়ের ব্যাবধানে সে পরিবারগুলোর জীবনযাত্রাকে পাল্টে দিয়েছে সাদা মাছের পোনা। তারা সাদা মাছের পোনা বিক্রি করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনের পাশাপাশি এলাকায় সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন তারা। খুলনা জেলার দিঘলিয়ার লাখোহাটি গ্রামে সাদা মাছের পোনা বিক্রিকে কেন্দ্র করে ঐ গ্রামের কয়েকশ পরিবার হয়েছেন লাখোপতি। কর্মসংস্থার অভাবে এক সময়ে এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষই খুবই দরিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত ছিল। সময়ের ব্যাবধানে ‘অভাব’ শব্দটি ভুলে গেছে লাখোহাটি গ্রামের মানুষ।
জানা গেছে, খুলনা দিঘলিয়ার লাখোহাটি গ্রামে প্রায় শতকোটি টাকার ও বেশি সাদা মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে। এই গ্রামে প্রতিদিন গড়ে দু’ থেকে আড়াই হাজার মণ মাছের পোনা ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রির জন্য পাঠানো হচ্ছে। ফলে ভরা মৌসুমে মাছের পোনা পরিচর্যা নিয়ে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছে এ গ্রামের মাছ চাষিরা। এসব গ্রামের খাল-বিল, ডোবা-নালা, ঘের ও পুকুর যেখানেই পানি, সেখানেই এখন মাছ আর মাছ। চলছে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্লাস কার্প, পুঁটি পোনার পরিচর্যা। আবার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে নতুন প্রজাতির মাছের পোনা।
বিভিন্ন মাছের পোনা পরিচর্যাকে কেন্দ্র করে পরিবহণ শ্রমিক দৈনিক মজুর, রিক্সা, ভ্যান, মাটির হাড়ি, খাবারের হোটেলসহ বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় এ গ্রামের জীবনমানের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। মাছচাষির সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। ব্যাংক ঋণ ও মৎস্য অধিদপ্তরের পরামর্শ ছাড়াই গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এ সাফল্য অর্জন করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুলনা মহানগরী ভৈরব নদের পূর্ব পাশে দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়নের লাখোহাটি গ্রাম। ১৯৬৫ সনে এ গ্রামের বাসিন্দা হরিপদ বিশ্বাস প্রথমে সাদা মাছের পোনা পরিচর্যার ব্যবসা শুরু করেন। এর কয়েক বছর পর তিনি দেশত্যাগ করে পাড়ি জমান ভারতে। কিন্তু তাঁর দেখানো পথেই স্থানীয়রা ঝুঁকে পড়ে সাদা মাছের পোনা পরিচর্যায়। এ গ্রাম থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, নড়াইল, ফরিদপুর, মংলা, রামপালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সাদা মাছের পোনা সরবরাহ করা হয়।
সূত্র জানায়, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ ব্যবসার মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এ সময় প্রতিদিন দু’ থেকে আড়াই হাজার মণ মাছের পোনা ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।
পোনা ব্যবসায়ী মো. মাহাবুব আলম লিটন এগ্রিনিউজকে বলেন, যশোর, ফুলতলা, শিরোমণি, খুলনার হ্যাচারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে কাতলা, গ্রাসকার্প, চাইনিজ পুঁটি, মৃগেলসহ বিভিন্ন রকমের মাছের ডিম এ বছর প্রথমে প্রতি কেজি ৮/১০ হাজার টাকা ও শেষের দিকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত কেনেন তিনি। মাছের ডিম কেনার পর নিজস্ব মৎস্য খামারে ছেড়ে দেন। এ বছর ১০ একর জমিতে পোনা মাছের চাষ করেন তিনি। আর এ বছর মোটামুটি লাভের আশা করছেন। গত বছর লাখোহাটি গ্রামের প্রায় সব মৎস্য খামার বন্যায় ভেসে যায়। যে কারণে লোকসানের ঘাটতি রয়েছে।
তিনি বলেন, মৎস্য অধিপ্তরের সাহায্য ও পরামর্শ পেলে লাখোহাটি গ্রামের মৎস্য চাষিদের লাভের পরিমাণটা আরো বেশি হত বলেও মনে করেন তিনি।
মাছ ব্যবসায়ী লিটু সরদার জানান, নিজস্ব ৫টি মৎস্য খামারে পোনা মাছের চাষ করছেন তিনি। সরকারি উদ্যোগে ব্যাংকে ঋণের ব্যবস্থা নিলে ব্যবসা আরো প্রসারিত হবে। তিনি আরো বলেন, মৎস্য অধিপ্তরের উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের কোন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। বারাকপুর ইউপি সদস্য কামরুল ইসলাম ও একজন পোনা ব্যবসায়ী বলেন, এই গ্রামের ৮৫ ভাগ মানুষ পোনা ব্যবসায়ী। এ গ্রামে বড় ও মাঝারি কয়েক শতাধিক পোনা মাছের ব্যবসায়ী রয়েছে। গত বছর লাখোহাটি গ্রামের প্রায় সব মৎস্য খামার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মাঝ চাষিদের জন্য নেই কোন ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাছ চাষিদের স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হলে এ অঞ্চলে সাদা মাছের পোনা বিক্রিতে বিপ্লব ঘটবে।
দিঘলিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান জানান, গত বছর লাখোহাটি গ্রামের মৎস্য খামার বন্যায় ভেসে যাওয়ায় তালিকা করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি কোন অনুদান ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষিরা আদৌও পাবে কিনা সে ব্যাপারে আমার কাছে কোন তথ্য নেই। আর এ গ্রামে পোনা চাষিদের পূর্বের ১৪৬ জনের একটা তালিকা রয়েছে। তবে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার কোন সুযোগ মাছচাষিদের নেই বলে তিনি জানান।