বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল এবং ইউ এস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউএসএসইসি) এর যৌথ উদ্যোগে গত ৩০ নভেম্বর কক্সবাজারের হোটেল দ্য কক্স টুডে-তে“প্রোটিন ফর অল” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বিপিআইসিসির সভাপতি জনাব মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন, সেমিনারে বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএসএসইসি এর প্রজেক্ট ম্যানেজার জনাব পাওয়ান কুমার, ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশনের সভাপতি জনাব শামসুল আরেফিন খালেদ, নাহার এগ্রো কমপ্লেক্স এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব রাকিবুর রহমান টুটুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ডা. খালেদা ইসলাম এবং বিশিষ্ট রন্ধন শিল্পী কেকা ফেরদৌসী প্রমুখ।
মডারেটর হিসেবে সেমিনারটি উপস্থাপনা করেন বিপিআইসিসির উপদেষ্টা জনাব শ্যামল কান্তি ঘোষ। সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নাহার এগ্রো কমপ্লেক্স এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব রাকিবুর রহমান টুটুল। অন্যান্যের মাঝে উপস্থিত ছিলেন, ব্রিডার্স অ্যাসেসিয়েশনের মহাসচিব জনাব সাইদুর রহমান বাবু, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জনাব এ.কে.এম শাহরিয়ার, কক্সবাজারের এলজিইডি এর নির্বাহী প্রকৌশলী জনাব মির্জা মো. ইফতেখার আলী। কক্সবাজারের প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সুপারিনটেডেন্ট মিসেস কামরুন নাহারসহ প্রায় ২০ জন প্রশিক্ষণার্থী, শিক্ষক শিক্ষিকা, কক্সবাজারের সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষসহ ছাত্রছাত্রী, সিটি কলেজ, মডেল হাই স্কুল এবং সৈকত বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক বলেন, কক্সবাজার জেলার স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য ডিম ও মুরগির মাংসের চাহিদা মেটাতে যোগান দেয়া হয় চট্টগ্রাম থেকে। তাই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত নেতৃবৃন্দকে এই এলাকায় পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য অনুরোধ করেন এবং এই ধরনের সেমিনারের মাধ্যমে আরও জনসচেতনতা সৃষ্টি করার আহবান জানান।
ওয়াপসার সভাপতি জনাব শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, প্রোটিনের চাহিদা পূরণে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, বিদেশীরা মাত্র ২.৫ শতাংশ হার সুদে টাকা এনে এদেশে বিনিয়োগ করছে। এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিযোগিতায় দেশীয় খামারি ও উদ্যোক্তারা এখনও কিভাবে টিকে আছে সেটাই আশ্চর্য্যরে বিষয়। তিনি আরো বলেন, আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন দরকার। একই সাথে স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষারও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড: খালেদা ইসলাম বলেন, আমরা অনেকেই জানিনা প্রতিদিন কি পরিমাণ প্রোিটন গ্রহণ করতে হবে, কখন গ্রহণ করতে হবে, প্রোটিনের মধ্যে কোনটি ভালো ইত্যাদি। তিনি আরো বলেন, সুস্থ্য-সবলভাবে বাঁচতে হলে পর্যাপ্ত এবং মানসম্পন্ন প্রোটিন গ্রহণের বিকল্প নেই। শিশুর দৈহিক গঠন ও মেধার বিকাশে এবং প্রসূতি মায়েদের পুষ্টিকর খাবার দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ যতœবান হওয়া দরাকর।
সেমিনারে ইউএসএসইসি এর কনসালট্যান্ট জনাব পাওয়ান কুমার বলেন, প্রত্যেকেই শত বছর বেঁচে থাকতে চায়। নেদারল্যান্ড তাদের সন্তানদেরকে সুস্থ্য ও দীর্ঘ দেহের অধিকারী দেখতে চায়, জাপানিরা তাদের স্বাস্থ্যকে অটুট রাখতে চায়। প্রত্যেক বাংলাদেশী সবার ওপরে থাকতে চায়। মানুষের দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার জন্য ২৫ শতাংশ নির্ভর করে জীনগত বৈশিষ্ট্যে এবং ৭৫ শতাংশই নির্ভর করে সুষম খাদ্য ও জীবনাচরনের ওপর। তিনি বলেন, বিশ্বের ৩৯টি দেশের মানুষের গড় আয়ু ৮০ বছরের উপরে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি ছিল মোনাকো’র (৮৯.৫) বছর। দ্বিতীয় অস্থানে ছিল জাপান (৮৫) বছর। এরপর সিঙ্গাপুর (৮৪.৯৫ বছর), হংকং (৮২.৪৪ বছর), ইতালী (৮২.৪৪ বছর), কানাডা (৮১.৮৫ বছর), যুক্তরাষ্ট্র (৭৯ বছর) এবং শ্রীলংকা (৭৬.৭৫ বছর)। গড় আয়ুর দিক থেকে ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৪ নম্বরে, গড় আয়ু ৭১.২৩ বছর। ভারতের অবস্থান ১৬৭ নম্বরে (৬৮.৪৫ বছর), নেপাল ১৬৮ নম্বরে (৬৭.৮৬ বছর) এবং পাকিস্তান ১৬৯ নম্বরে (৬৭.৭৩ বছর)। তিনি বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ জাপান তার দেশের মানুষের গড় আয়ু ৮৫ থেকে বাড়িয়ে ৯১.৫৮ বছরে এবং সিঙ্গাপুর ৯১.৫৫ বছরে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সেখানে বাংলাদেশও তাদের গড় আয়ু বৃদ্ধি করার জন্য সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনা নেয়া উচিত। আর তা করতে হলে খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন মানুষকে প্রোটিন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
বিশিষ্ট রন্ধন শিল্পী কেকা ফেরদৌসী বলেন, ব্রয়লার মুরগির মাংস দিয়ে যত রকমের মজাদার খাবার তৈরি করা যায় অন্য কোন কিছু দিয়ে তা হয় না। এখনকার ছেলে-মেয়রা তো ব্রয়লার মুরগির মাংসই বেশি পছন্দ করে। মুখরোচক খাবার নয় বরং সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাবারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। ডিম, দুধ, মাছ, মাংস ইত্যাদি খাবারগুলো প্রোটিনের ভালো উৎস।
সেমিনারের সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, প্রোটিন আমরা প্রাণিজ উৎস অর্থাৎ ডিম, মাংস ও মাছ এবং উদ্ভিদজাত উৎস অর্থাৎ ডাল জাতীয় ফসল থেকে পেতে পারি। ডিম, মুরগীর মাংস এবং মাছকে প্রথম শ্রেণীর প্রোটিন এবং উদ্ভিদজাত পোট্রিনকে দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রোটিন বলে। প্রতিদিনের খাবারে ভাত, রুটি, ডাল, তরকারির মত মাংস, ডিম ও মাছ আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। প্রোটিনের এই প্রয়োজন শুরু, শিশু যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখন থেকেই। শিশু কিশোর ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য ডিম, মুরগীর মাংসের পরিমাণ বেশি বেশি প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ প্রায় ৬৬ গ্রাম; এর মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ আসে প্রাণিজ উৎস থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু প্রোটিন কনজাম্পশন ৮৩ গ্রাম যার ৬৭ শতাংশই আসে প্রাণিজ আমিষের উৎস থেকে। কাজেই শুধু প্রোটিন খেলেই হবে না, প্রাণিজ উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন খাওয়ার পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। আপনারা জানেন বর্তমান সরকার ‘খাদ্য নিরাপত্তা’র পাশাপাশি এখন ‘পুষ্টি নিরাপত্তা’র উপর জোর দিয়েছেন। প্রতি বছর অন্তত: ৫৩ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করছে অপুষ্টিজনিত জটিলতার কারণে। আরও বলা হচ্ছে- ৪২% কিশোরী অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে অপুষ্টিতে ভুগছে। মাতৃত্বকালীন অপুষ্টির ((maternal malnutrition) ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। তাই উন্নত দেশ ও জাতি গড়তে হলে আমাদেরকে অপুষ্টির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতেই হবে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, আমার চাকরি জীবনে অনেক সেমিনার, ওয়ার্কশপে যোগদান করেছি যার সবই পেশাগত কারণে এবং নিজের পেশাকে উন্নত করার জন্য। কিন্তু আজ এই ৩-৪ ঘণ্টার সেমিনারে এসে মনে হলো নিজের জীবনের জন্য কিছু শিখলাম। যেটা আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন কাজে লাগবে। উপপরিচালক কৃষি সম্প্রসারণ বলেন, এই এলাকায় পোল্ট্রি খাদ্যের একটি বড় উপাদান ভূট্টার চাষ ২/৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি চেষ্টা করবেন ভুট্টার সাথে সাথে সয়াবিনের চাষও বৃদ্ধি করার জন্য। পিটিআই সুপার বলেন, তারা আজ যে সমস্ত বিষয় অবগত হলেন প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক তাদের পাঠ্যে পুষ্টির বিষয় বুঝতে সহায়তা করবে এবং তারা সেটি যথাযথভাবে প্রয়োগ করারও চেষ্টা করবেন। শিক্ষার্থী এবং ছাত্র ছাত্রীরা নানা প্রশ্ন তুলে ধরেন। অনেকেই প্রশ্ন করেন পোল্ট্রি মুরগি বৃদ্ধিতে কোন এন্টিবায়োটিক বা হরমোন ব্যবহার করা হয় কিনা। এ ব্যাপারে রাকিবুর রহমান টুটুল বলেন, মুরগি যাতে সহজে খাবার হজম করতে পারে এবং যথাযথ পুষ্টি পায় সেভাবেই ফিডের ফর্মুলা তৈরি করা হয়। তিনি আরো বলেন, একই খাবার যদি একটি দেশী মুরগিকে খাওয়ানো হয় সেটি কখনও ফার্মের মুরগির মত বৃদ্ধি পাবে না। এর কারণ হচ্ছে জেনেটিক ডেভেলপমেন্ট।
উন্নত বাংলাদেশেও জরুরী