শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

আতঙ্কে আছেন দুবলার চরের শুঁটকি পল্লীর জেলেরা

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা): সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকি পল্লীতে কর্মমূখর সময় পার করছেন জেলেরা। শুঁটকি মৌসুমকে ঘিরে একদিকে ব্যাস্ততা অন্যদিকে জলদস্যু আতংকের মধ্য দিয়েই তারা দিন পার করছেন। এছাড়াও রয়েছে শুঁটকি পল্লীর নিয়ন্ত্রণের আধিপত্য এবং মহাজনের দাদনের চক্র বৃদ্ধির সুদের বোঝা মাথায় নিয়েই চলছে তাদের শুঁটকি মৌসুমের কর্মব্যাস্ততা। এ পরিস্থিতিতে জেলেরা এবারের মৌসুমে মৎস্যজীবীরা যাতে সুষ্ঠুভাবে মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়া করতে পারেন তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের কঠোর নজরদারির দাবি জানান। শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির হিসেবে, সুন্দরবনের এ দুবলার চর শুঁটকিপল্লীতে বছরে প্রায় ৫ হাজার টন শুঁটকি মাছ উৎপাদিত হয়। যা দেশে মোট উৎপাদিত শুঁটকির ৮০ শতাংশ।

জানা গেছে, সুন্দরবনের মাঝে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় দুবলার চরসহ সাতটি চরে গত চার দশক ধরে গড়ে উঠেছে দুবলা শুটকী পল্লী। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাস চালু থাকে শুঁটকি তৈরীর এই মৌসুম। এরই মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার ২০ হাজার জেলে ও ব্যবসায়ী দুবলা শুঁটকি-পল্লীতে সাগর থেকে ধরা মাছ দিয়ে শুঁটকি তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর অক্টোবর মাস থেকে সুন্দরবনের দুবলার চরে ভিড় জমান জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। এরপর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস মাছ আহরণ করে শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন তাঁরা। ৩০ হাজার জেলে ও মৎস্যজীবীর খেয়ে-পরে বাঁচা-মরা নির্ভর করে এর মাধ্যমে।

শুঁটকি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুবলা শুঁটকিপল্লী গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। তাই সনাতন পদ্ধতিতে ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে এখানে মানসম্পন্ন শুঁটকি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি সহায়তায় শুঁটকিপল্লীর আধুনিকায়ন হলে গুণগত মানসম্পন্ন শুঁটকি উৎপাদন ও রপ্তানি কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করে ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে সাগরের মৎস্য সম্পদ থেকে আয় বাড়াতে দুবলা শুঁটকি পল্লীর আধুনিকায়নের উদ্যোগের কথা জানালেন সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তারা।

কিন্তু চলতি বছর দুবলার চরে জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীদের জমায়েত নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দুবলার চরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পেশিশক্তি ও ক্ষমতার দাপটের লড়াই শুরু হয়েছে। আর এতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীদের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার ও দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহমদ মারা যাওয়ার পর এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুবলার চরের মৎস্যজীবীরা জানান, মেজর জিয়াউদ্দিন দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে ৩৪-৩৫ বছর দুবলার চরসহ সুন্দরবন উপকূলে শীতকালে শুঁটকি মাছ আহরণসহ বছরব্যাপী বঙ্গোপসাগরে সুন্দরবন উপকূলের মাছ ব্যবসার প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী ছিলেন। এ ব্যবসায় জিয়াউদ্দিনের সহযোগী ছিলেন তাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন, ভাগ্নে শাহনুর রহমান শামীম প্রমুখ। এছাড়া কক্সবাজার এলাকার জগন্নাথ বহরদার, সাবের বহরদার, অনীল বহরদার, খুলনার মাসুম চৌধুরী, মোংলার বুলবুল ইজারাদারসহ আরো কয়েকজন ব্যবসা করতেন।

দুবলার চরের কয়েকজন প্রবীণ মৎস্যজীবী জানান, ১৯৮২ সালের দিকে মেজর জিয়াউদ্দিনের পাশাপাশি খুলনার কিছুব্যক্তি সুন্দরবনের দুবলার চরে চিংড়ি ব্যবসা ও অন্যান্য মাছের ব্যবসা এবং শুঁটকি মাছ পরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে অন্য এক প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ীকে নিয়ে সুন্দরবনে অবস্থানকারী বিভিন্ন প্রশাসনের সহায়তায় আলোরকোল চরের সমস্ত মাছের ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নেন খোকন নামের এক ব্যবসায়ী । এক পর্যায়ে খোকন দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে নিজের প্রতিপত্তি ও প্রভাব সংহত করেন। সুন্দরবন উপকূলের ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, কয়রা, দাকোপ, রামপাল প্রভৃতি এলাকায় ক্ষুদ্র মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেরা খোকনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কেউ কেউ সুন্দরবনের সাগরে মাছ আহরণে নিয়োজিত হয়েছেন।

কয়েকজন জেলে মহাজন অভিযোগ করে বলেন, দাদন ব্যবসা, বন বিভাগের রাজস্ব ফাঁকি, ছোট মাছ ব্যবসায়ীদের ভাগের টাকা মেরে দেওয়া, জলদস্যু-বনদস্যুদের সঙ্গে যোগসাজশে জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়সহ অবৈধ পথে এই ব্যক্তি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এই অর্থ পুঁজি হিসেবে খাটিয়ে দুবলার চরের মাছের ব্যবসায়ও তিনি তাঁর অবস্থান শক্তিশালী করেন।

জেলে-মহাজনরা জানান, মেজর জিয়াউদ্দিনের জীবিত অবস্থায় দুবলার চরসহ সুন্দরবনে প্রকাশ্যে দাপট বা দৌরাত্ম্য দেখাননি কোন ব্যাবসায়ী। তবে জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুর পর খান সফিউল্লাহ খোকন নামের এক ব্যবসায়ী সেখানে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। এরই মধ্যে মেজর জিয়াউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ ও আত্মীয়-স্বজনকে দুবলার চর থেকে উৎখাত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকার সন্ত্রাসীদের সেখানে নিয়োজিত করছেন। যাতে এ ক্যাডার বাহিনী সুন্দরবনে মেজর জিয়ার অবর্তমানে অবস্থান নিয়ে মাছের ব্যবসার আড়ালে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, অস্ত্রভাণ্ডার হিসেবে সুন্দরবনের গহিন অরণ্য ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে দুর্গম চরাঞ্চলটি অপরাধী চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন দুবলার চরের জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।

এ ব্যাপারে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এবারের শুঁটকি মৌসুমে যাতে কোনো ধরনের অরাজকতা অথবা সংঘাত সৃষ্টি না হয় সে জন্য বন বিভাগের পাশাপাশি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সজাগ দৃষ্টি রাখছে।কোস্টগার্ড পশ্চিম (মোংলা) জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, শুঁটকি মৌসুমে যাতে কোনো সংঘাত ছাড়াই মৎস্যজীবীরা সুষ্ঠুভাবে মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়া করতে পারেন, সে জন্য কোস্টগার্ড সদস্যরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। সেখানে কোনো অবস্থাতেই অপশক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

 

 

This post has already been read 3162 times!

Check Also

যে জেলায় ইলিশ উৎপাদন হয়, ওই জেলার মানুষ গরিব হতে পারে না -মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

ভোলা সংবাদদাতা: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, ইলিশের সম্পদ রক্ষায় সবাইকে একসাথে কাজ …