ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা):
প্রতি বছর শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথে খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুরসহ উপকুলীয় অঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করে অতিথি পাখি। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠে উপকুলীয় জেলার নিন্মাঞ্চল। উপকুলীয় বিভিন্ন উপজেলার বড় বড় হাওরের জলাশয়ে খাবারের সন্ধানে প্রতি বছরই শীত মৌসুমে এসে জড়ো হয় বিভিন্ন প্রজাতির বাঁলি হাঁস, ল্যান্জা হাঁস, চখা, পাণকৌড়ি, ডাহুক, সরালী ও কাইমসহ শত প্রাজাতির অতিথি পাখি। এ সকল বিদেশি অতিথি পাখিরা শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা ও খাবারের সন্ধানে হাজারো মাইল পাড়ি দিয়ে সাইবেরিয়া থেকে আসে এ সকল উপকুলীয় ও হাওরঞ্চলে।
সুদূর থেকে আসা এ সকল অতিথি পাখি শিকার সম্পুর্ণভাবে নিষিদ্ধ। অথচ এক শ্রেনীর অসাধু পাখি ব্যবসায়ী ফাঁদ পেতে অতিথি পাখি নিধনে মেতে উঠে। পাখি শিকারিরা এ সকল পাখি স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করছে প্রকাশ্যে। শীতের শুরুতেই এবার অতিথি পাখিদের আগমন শুরু হওয়ার সাথে শুরু হয়েছে অতিথি পাখি নিধন। এক শ্রেনীর পেশাদার ও সৌখিন শিকারিরা নির্বিচারে অতিথি পাখি নিধনের মহোৎসব শুরু করেছে। খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা, কয়রা, তরেখাদা, ডুমুরিয়া উপজেলার অধিকাংশ খাল-বিল ও জলাশয় গুলোতে অতিথি পাখি আশ্রয় নিয়েছে। পাখি শিকার করা আইনত নিষিদ্ধ হলেও এ ব্যাপারে প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। অতিখি পাখি নিধন বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি ও সংশ্লিষ্ট বন্যপ্রাণী দপ্তরসহ পুলিশ প্রশাসনের হস্থক্ষেপ কামনা করছেন সচেতন মহল।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, প্রতিবছর শীত আসলেই দেখা মেলে অতিথি পাখিদের। আর শীত শেষ হলই আবার ফিরে যায় গন্ত্যব্যে। প্রতিবছর এসব অতিথি পাখি আসে সুদূর হিমালয় ও সাইবেরিয়াসহ শীত প্রধান অঞ্চল থেকে। খুলনার মাগুরখালী, শিবনগর, কাঠালিয়া, ঘুরুনিয়া, লাঙ্গলমাড়া, বগারখার, কুলটি, জালেরডাঙ্গা, ভল্কামারী, খড়িয়া, পশ্বিম বিলপাবলা, গগনা খাল, বাইসরানী, রংপুর, বিল ডাকাতিয়া, মির্জাপুর, শোভনা, কদমতলা, কাকমারী, বলাবুনিয়া, জিয়ালতলা, শিবপুর, মাদারতলা, ব্রহ্মারবড়, বারুইকাটি, বৈঠাহারা, আধারমানিক, নিচুখালী, চেচুড়ি, বরুনা, দহকুলা, রুদাঘরা, শরাফপুর, সাহস, গোপালনগর, কাঞ্চননগর, তেলিখালী, খড়িবুনিয়া, মাগুরাঘোনা, কাঞ্চনপুর, তালতলা, মাগুরখালী নদী, বেজিআলির খাল, খলসীর চোয়ার খাল, বেতাগ্রাম, হাসানপুর, ঘোষড়া, বাদুড়িয়া, কাকুড়পাড়া, বিলতাওলিয়া, মধুগ্রাম, কালবিল, হামকুড়া খালসহ বিভিন্ন ছোট বড় বিল ও ডোবায় বিপুল পরিমান অতিথি পাখি আশ্রয় নিয়েছে।
কিন্তু এক শ্রেনীর পেশাদার ও সৌখিন শিকারিরা বিষটোবসহ নানা কৌশল অবলম্বন করে এসব পাখি শিকার করছে। পাখি শিকারী সঞ্জয় মন্ডল, কাশিনাথ গাইন, বিপিন মন্ডল, সুশান্ত রায়, মনিশংকর মন্ডলসহ এলাকার ২০/২৫জন চিহ্নিত শিকারীরা রাত গভীর হলেই ফাঁদ পেতে, কারেন্টজাল, বাঁশি বাজিয়ে, বিষটোপ, ছিকল দিয়ে পাখির ডাক মোবাইলে রেকর্ড করে নানা কৌশলে অতিথি পাখি শিকার করছে। এরপর পাখিগুলো বিভিন্ন বাজারে বিশেষ করে থুকড়া, কাঞ্চনপুর বাজার, আঠারোমাইল, মাদারতলা, বেয়ারশিং, বারাআড়িয়া হাট বাজারে সুযোগ বুঝে বিক্রি করছে। তবে ক্রেতারাও খুব চতুর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতা জানায়, শিকারীদের সাথে আমাদের যোগ-সাজস রয়েছে। অনেক সময় গোপনীয় জায়গা থেকেও পাখি কিনতে হয়। আমাদের কাছ থেকে পুলিশ-প্রশাসনের বড় কর্মকর্তারাও কিনে থাকেন। যার ফলে কোন সমস্যা হয়না বলে তিনি জানান। পাখিদের মধ্যে রয়েছে কালকুচ পাখি, জলকুচ পাখি, কড়ই পাখি, আলতি পাখি, ডাক পাখি, বাইল হাস, ডঙ্কুর পাখি, কান পাখিসহ ইত্যাদি। এসব পাখি জোড়া প্রতি ৩’শ থেকে শুরু করে ৭’শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
২০১২ সালর বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক লাখ টাকা জরিমানা, এক বছরের কারাদন্ড বা উভয় দন্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণ। আইন এসব শাস্তির উল্লেখ থাকলেও প্রয়োগকারী সংস্থার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে পাখি নিধন। উদাসীন বন বিভাগের নজরে আসেনা এসব ঘটনা। চলতি বছরের শীতের শুরুতে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ থেকে অতিথি পাখি নিধন বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দেওয়া হেয়েছ।
মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, অতিথি পাখি নিধন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সম্প্রতি জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে পাখি নিধন বন্ধে পদক্ষেপ নেবে। এতে সহায়তা করবেন বন বিভাগ। জেলা প্রশাসকরা স্থানীয় জনগণকে সচেতন করবে পাখি নিধন বন্ধ করতে।ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খান আলী মুনসুর বলেন, অতিথি পাখিরা সুদূর হিমালয় ও সাইবেরিয়াসহ শীত প্রধান অঞ্চল থেকে আমাদের এলাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। জীবন বাঁচাতে আসা এসব পাখিদেরকে শিকার করা দন্ডনীয় অপরাধ বলে আমি মনে করি। তাছাড়া পাখি নিধন হলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে।
এ প্রসঙ্গে বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ খুলনার রেঞ্জ অফিসার মো. মোসলেম আলী বলেন, অতিথি পাখি নিধন বন্ধে এবার শক্ত পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। খুলনার ডুমুরিয়া,বটিয়াঘাটা,ফুলতলা,শাহাপুর, খর্ণিয়া, থুকড়া, বাগেরহাটের চিতলমারি, তেরখাদাসহ বিভিন হাটবাজারে ইতোমধ্যে মাইকিং ও বিভিন্ন সভা করে অতিথি পাখি ও কচ্ছপ নিধন বন্ধে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছি। পাখির আবাসপ্রবন উপকুলীয় এলাকার সাধারন মানুষের মাঝে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাগেরহাট এলাকা থেকে এক শিকারীকে এয়ারগানসহ আটক করা হয়েছে। এখনো অনেক হাট বাজারে অভিযানে গিয়ে দেখি শিকারীরা বন বিভাগের গাড়ির খবর পেয়ে অতিথি পাখি ফেলে পালাতে, পরে সে পাখি উন্মুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া আমাদের অর্থ সংকট থাকায় অভিযান করতে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও অভিযান অব্যাহত রেখেছি। সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পেলে পাখি নিধন বন্ধ করা সম্ভব হবে।